মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী 23 February, 2022 10:59 AM
বাংলাদেশের ইসলামী অঙ্গনে ৮০ ও ৯০ এর দশকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বড় পুত্র তিনি। খেলাফত আন্দোলন নামে রাজনীতিতে পদার্পণ ও প্রেসিডেন্ট ইলেকশানে প্রতদ্বিন্দিদ্বতা একসময় হাফেজ্জি হুজুরকে ব্যাপক পরিচিতি দেয়। এমনিতে তিনি হযরত থানভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির খলিফা ও রাজধানীর আলেম সম্প্রদায়ের পথিকৃত হিসাবে দেশের সব আলেমের মান্য ব্যক্তি ছিলেন। বর্ষীয়ান মুরব্বী হিসাবেও তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। হাফেজ্জির ইন্তেকালের পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আহমাদুল্লাহ আশরাফকেই খেলাফতের আমীর মনোনীত করা হয়। তখন তিনি হাফেজ্জি ভক্তদের ‘বড়ভাই’। দেশের তরুণ সমাজ তখন এই বড়ভাইকে ঘিরেই সংগঠিত। সেসময়ের কথা মনে পড়লেও এখন কষ্ট হয়। কারণ, বটগাছের ছায়া তলে তখন এদেশের প্রায় সব আলেমই সংঘবদ্ধ ছিলেন।
হাফেজ্জি হুজুরের দল থেকে আলাদা হতে হতে গোটা বাংলাদেশ আজ দলে, সংগঠনে ভরে গেছে। তখন হযরত শায়খুল হাদীস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হাফেজ্জির ডান হাত। বাম হাত চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ব্যারিষ্টার কোরবান আলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, মুফতি ফজলুল হক আমিনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ দেশের শত শত শীর্ষ আলেম নেতৃবৃন্দকে নেই হুজুরের সাথে। ইসলামী ঐক্য ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যদি সবাই দয়া করে বড়ভাইকে সামনে রেখে হযরত হাফেজ্জি হুজুরের ইমেজটি ধরে রাখতেন, যদি তারা শত বছরে গড়ে উঠা বটবৃক্ষের ছায়ায় একটু ধৈর্য ধরে টিকে থাকতেন তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস আজ অন্যরকম হতে পারতো। দুনিয়া জুড়ে আমরা বহু উন্নত রাষ্ট্র দেখতে পাই, এদেশেও বড় দলগুলোতে আমরা দেখি ঐক্যের জন্য ততটা যোগ্য না হওয়া সত্যেও সন্তানকে, স্ত্রীকে নেতা মেনে যোগ্যতর লোকেরা সংঘবদ্ধ থাকে এবং লক্ষ্য অর্জন করে। এসব কথা কেউ অন্যভাবে নিবেন না। সাধারণ মানুষ যা বোঝে আলেমগণ যদি সেটি চিন্তা করতেন ও বুঝতেন তাহলে তারা আরও বহুদূর এগোতে পারতেন।
বড়ভাইয়ের নামের উপর এক হয়ে যদি সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে শক্তিশালী শুরা কাজ করতো, তাহলে আজ ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোটসহ আরও বহু সংগঠনের জন্মলাভেরই প্রয়োজন পড়তো না। এবং ইসলামী আদর্শের উপর গণমানুষের প্রচুর আকর্ষণ ও আস্থা দিনদিন বাড়ার সাথে সাথে ইসলামী সংগঠনের নামে মানুষকে বহুভাগে বিভক্ত হওয়ার মুসিবতেও পড়তে হতো না। যা সম্ভাবনাময় আগামীর বাংলাদেশের ইসলামী আদর্শের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ না থাকা বা লক্ষ্য, নীতি আদর্শ নিয়ে খুব চিন্তা না করা এদেশের ইসলামী অঙ্গনের আচরণে দেখা যায়। সামান্য মনোমালিন্যে দল ভাঙ্গা যেন বড় কোনো ঘটনা নয়। মনে চাইলে নতুন দল তৈরির ঘোষণাও এখানে কোনো বিষয় নয়। যার ফলে আজ অনেক যোগ্য ও বিশ্বস্ত নেতৃত্বের স্মৃতিবহ সংগঠন নিজেদের ঈমান-ঐতিহ্য ভুলে লজ্জাজনক বালখিল্যতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। এ যেন নিয়তির নির্মম পরিহাস। যারা রাতদিন ঈমান, স্বাধীনতা ও দীনি চেতনার বাণী জাতিকে শোনাতেন, দলমত নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক তৌহিদি গণমানুষ যাদের আওয়াজকে নিজেদের হৃদস্পন্দন বলে মনে করতো, সময়ের ব্যবধানে আজ সেই সিংহের দলই অবলীলায় ভেড়ার পালে মিশে গেছে। যারা জাতিকে ‘মোজাদ্দেদে আলফেসানি’র কাহিনী শুনিয়ে ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার হিম্মত জোগাতেন তারাই কেন জানি আজ ‘আবুল ফজল ও ফয়েজি’র মতো নোংরা আচরণ করছেন। এ ধরনের ভাঙ্গন ও বিবর্তন দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করলেও বা কেউ এ বিষয়ে রক্তের অশ্রু বইয়ে দিলেও কোনো কাজ হবে কি না তা আজ আর স্পষ্ট নয়।
শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন সাহসী, সদালাপী, অতিথি বৎসল ও সাদা মনের মানুষ। দেশে বিদেশে দীনি শিক্ষা অর্জন করেছেন, বহু আকাবির ও বুযুর্গ-মনীষীর সাথে মিশেছেন। পিতার নির্দেশে জাতীয় মসজিদে কেরাত পড়েছেন, আযান দিয়েছেন। তার আযান একসময় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমকে মুসল্লিদের অন্তরের আকর্ষনের মসজিদ রূপে অভিষিক্ত করেছিল। একবার তিনি কাবার মিনারেও আযান দিয়েছিলেন। পরে নানা দায়িত্বের ফলে আর আযান দিতেন না। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান আযানের যে মূল সুর তা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের সুরেরই অনুরণন। সোভিয়েত দখলদারির সময় আফগানরা যে স্বাধীনতার লড়াই করেন, যখন আরব ও আমেরিকানরাও আফগানদের সমর্থক ছিল, যখন আফগানদের দুনিয়া সন্ত্রাসী বলা শুরু করেনি তখন তার একপুত্র ‘মাওলানা রহমাতুল্লাহ’ আফগান যুদ্ধে শহীদ হন। বড়ভাই সবসময় জিহাদকে জিহাদ বলতেন, সন্ত্রাসকে সন্ত্রাস। কোনো অপপ্রচারেই তিনি ভীত হননি। জীবনে বহু চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু স্বাভাবিক নীতি ও স্বতসিদ্ধ আদর্শ থেকে সরে যাননি। বিশেষ করে নাস্তিক মুরতাদদের উত্থানের সময় যখন সারা দেশ ঘুমিয়ে, তখনও তিনি একাই জেগে ছিলেন। যখন তখন প্রতিবাদে রাস্তায় নামতেন। গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, গোলাপ শাহ, বায়তুল মোকাররম ছিল তার প্রতিবাদের মাঠ। ছাত্র-ভক্তদের নিয়ে খেলাফতের ব্যানারে, কখনো কখনো দেশ বাঁচাও ঈমান বাঁচাও-শ্লোগানে তাকে মাঠে ময়দানেই দেখা গেছে জীবনভর।
একথা স্পষ্ট যে, মুফতি আমিনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বেঁচে থাকলে এ দেশে নাস্তিক্যবাদী জাগরণ সম্ভবই হতো না। যদিও হতো তাহলে এটি প্রতিহত করতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামক নতুন সংগঠনের প্রয়োজন পড়তো না। কারণ, মুফতি আমিনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ১৫ কোটি মুসলমানের ঈমানের কথা উচ্চারনের বজ্রকণ্ঠ। আমিনী সাহেবের অবর্তমানে এই পতাকা হাতে তুলে নেন বড়ভাই। যখন পুলিশি আক্রমনে রাজপথে নামা আর সম্ভব হয়নি তখন তিনি মনের আবেগে নূরীয়া মাদরাসার মাঠেই কর্মী, ছাত্র-ভক্তদের নিয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করতেন। মিডিয়াকে বলতেন, আমার পায়ের বেড়ি নিয়েও যে ক’কদম পারি আমি আল্লাহর পথে চলতে চাই। কণ্ঠ রুদ্ধ হলেও শক্তি থাকা পর্যন্ত নিজ গন্ডিতেই-শ্লোগান তুলতে চাই। জাতির পক্ষ থেকে ফরজে কেফায়া আদায় করা ছাড়া আমরা কেউই আল্লাহর গজব থেকে নিস্কৃতি পাব না। ফটো সাংবাদিকরা তখন তার অবরুদ্ধ মিছিলের ছবি পত্রিকায় ছেপে দিতেন। তারা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের ব্যথা যন্ত্রনার সাক্ষী। তার এই ক্ষীণকণ্ঠ একসময় আঞ্চলিক উদ্যোগ হেফাজতে ইসলামকে রাজপথে টেনে আনে। যদিও হেফাজতের সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে দেশবাসির মনে সংশয়ের সীমা পরিসীমা নেই। খোদ হেফাজতের নেতা-কর্মীরাও যেখানে আশা নিরাশার দোলাচলে নিমজ্জিত। সেখানে আহমাদুল্লাহ আশরাফ তার শেষ সচেতন মুহূর্ত পর্যন্ত নির্ভীক, নির্লোভ ও সৎ থেকে গেছেন। প্রায় ৪ বছর একরকম অচেতন অবস্থায় থেকেও তার নূরানী চেহারা বিন্দুমাত্রও ম্লান হয়নি।
৭৬ বছরেও তার শানিত ব্যক্তিত্ব কিছুমাত্র নিষ্প্রভ হয়নি। যেখানে বর্তমান বহুমুখি ফেতনার যুগে সুস্থ সবল বহু লোকজন প্রচুর সুখ-সুবিধায় থেকেও তাদের ঐতিহ্যবাহী ঈমানী নূর হারিয়ে ফেলছে। তাৎক্ষনিক অনুভূতি প্রকাশের বেলায় এর বেশী আর কিছু বলার সুযোগও নেই। তবে মনের গভীর থেকে বড়ভাইজানকে শ্রদ্ধা জানাই। আল্লাহ তার সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিন। তার মাগফেরাত করুন। তার প্রতিটি নেক আমল কবুল করুন। ভুলক্রুটির কাফফারা করে দিন। তিনি তার পিতা হযরত হাফেজ্জি হুজুর রাহমাতুল্লাহি আলাইহির পাশেই অন্তিম শয্যা গ্রহণ করেছেন। তার কবর যিয়ারতের সময় যিয়ারতকারীরা চিরদিনই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। কারণ, তিনি তার সমগোত্রীয়দের মাথা হেঁট করে যাননি। তিনি বুক ভরা সাহস, চেতনা, ঈমান, দৃঢ়তা ও উন্নত দৃষ্টি নিয়েই বেঁচে ছিলেন। এ মহামূল্যবান সম্পদগুলো সাথে নিয়েই বীরের মতো বিদায় হয়েছেন।
অতএব, তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যারাই দোয়া করবেন তারা যেন আল্লাহর কাছ থেকে বুক ভরা সাহস, চেতনা, ঈমান, দৃঢ়তা ও উন্নত দৃষ্টি চেয়ে নেন। ভয়ভীতি, লোভ-লালসা যাদের অন্ধ করে দেয়, বেহায়া করে দেয় তাদের জন্যও তওবার দরজা খোলা। কারণ আল্লাহ ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, যতবার তুমি অন্যায় কর, ততবারই তুমি আমার কাছে তওবা করতে পার। আল্লাহর রহমত থেকে ঈমানদার কখনো নিরাশ হয় না। আমরা সবার জন্যই সুপথ কামনা করি। আর যারা দুনিয়ার মোহে পড়ে হেদায়াত থেকে বহু দূর চলে গেছে, যাদের অন্তরে আল্লাহর কহর পড়েছে, যাদের দিলে তাদের পাপের জন্য সিলমোহর পড়ে গেছে, যাদের আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই দয়া করে তারা যেন এই সাহসী ও সংগ্রামী নবী প্রেমিকের কবরের পাশে না দাঁড়ায়। আমার সাক্ষ্য মতো, শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ একবিংশ শতাব্দির আহমদ সরহিন্দি। তিনি ৫০০ বছর পর ঢাকার মোজাদ্দেদে আলফেসানি। তিনি চির অমর। তার মৃত্যু নেই। অনাগত সময়ের প্রতিটি দীনি সৈনিকের তিনি প্রেরণা। নতুন প্রজন্ম তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারে।