রহমত ডেস্ক 04 December, 2021 06:50 PM
চলতি বছরের নভেম্বর মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭৯টি। নিহত ৪১৩ জন এবং আহত ৫৩২ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭, শিশু ৫৮। ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৮৪ জন, যা মোট নিহতের ৪৪.৫৫ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১.৬৮ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৬ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৩.২৪ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫৩ জন, অর্থাৎ ১২.৮৩ শতাংশ। এই সময়ে ৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং ৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত এবং ২ জন আহত হয়েছে।
আজ (৪ ডিসেম্বর) শনিবার রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র : দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৮৪ জন (৪৪.৫৫%), বাস যাত্রী ২৩ জন (৫.৫৬%), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি যাত্রী ১২ জন (২.৯০%), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স-জীপ যাত্রী ৯ জন (২.১৭%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-টেম্পু-লেগুনা) ৬৬ জন (১৫.৯৮%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম)১৭ জন (৪.১১%) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ৬ জন (১.৪৫%) নিহত হয়েছে।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন : রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৫৬টি (৪১.১৬%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৩১টি (৩৪.৫৬%) আঞ্চলিক সড়কে, ৫৩টি (১৩.৯৮%) গ্রামীণ সড়কে, ৩৫টি (৯.২৩%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৪টি (১.০৫%) সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন : দুর্ঘটনাসমূহের ৮৯টি (২৩.৪৮%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৩৩টি (৩৫.০৯%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৯১টি (২৪%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৫৯টি (১৫.৫৬%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৭টি (১.৮৪%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন : দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২১.৪২ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রাম ট্রাক ৩.৮৪ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স-জীপ ৫.৩১ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১১.৫৩ শতাংশ, মোটরসাইকেল ৩০.৫৮ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-লেগুনা-টেম্পু) ১৯.৯৬ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) ৪.৩৯ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১.৯৩ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা : দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৪৬টি। (ট্রাক ৭৮, বাস ৬৩, কাভার্ডভ্যান ১২, পিকআপ ২৭, ট্রলি ৮, লরি ৩, ট্রাক্টর ৬, মাইক্রোবাস ১৩, প্রাইভেটকার ১১, এ্যাম্বুলেন্স ৩, জীপ ২, পুলিশ পিকআপ ২, ড্রাম ট্রাক ৪, মোটরসাইকেল ১৬৭, থ্রি-হুইলার ১০৯ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-টেম্পু-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ২২ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১৬টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ : সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৫%, সকালে ২৭.১৭%, দুপুরে ১৭.৪১%, বিকালে ২২.১৬%, সন্ধ্যায় ৬.৮৬% এবং রাতে ২১.৩৭%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান : দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৬.৫৭%, প্রাণহানি ২৬.৫১%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.৯৪%, প্রাণহানি ১৩.৪২%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯.৩২%, প্রাণহানি ২১.৮১%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.১৭%, প্রাণহানি ৭.৭১%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.২১%, প্রাণহানি ৬.০৪%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.২৪%, প্রাণহানি ৭.০৪%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৭৬%, প্রাণহানি ৯.৭৩% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.১৬%, প্রাণহানি ৭.৭১% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৮৩টি দুর্ঘটনায় নিহত ১০৪ জন। সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে। ২২টি দুর্ঘটনায় নিহত ২৪ জন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ২১টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন নিহত। সবচেয়ে কম লালমনিরহাট জেলায়। ২টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কেউ হতাহত হয়নি। রাজধানী ঢাকায় ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছে।
আহত ও নিহতদের পেশাগত পরিচয় : গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ২ জন, সেনা সদস্য ১ জন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১১ জন, চিকিৎসক ৩ জন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইঞ্জিনিয়ার ১ জন, সাংবাদিক ৪ জন, ইমাম ২ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ৯ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ১৭ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ২৩ জন, পোশাক শ্রমিক ৭ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৪ জন, ইটভাটা শ্রমিক ২ জন, ধানকাটা শ্রমিক ৩ জন, জুতা কারখানার শ্রমিক ৫ জন, রাজমিস্ত্রি ১ জন, কাঠমিস্ত্রি ১ জন, ইলেক্ট্রিশিয়ান ১জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ৩ জন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ৭ জন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নটরডেম কলেজের ২ জনসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ : ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০ গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ : ১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১০.“সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত অক্টোবর মাসে ৩৪৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত হয়েছিল। গড়ে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১১.১৬টি এবং নিহত হয়েছিল ১৩.১২ জন। নভেম্বর মাসে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪০৭ জন। গড়ে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটেছে ১২.৬৩টি এবং নিহত হয়েছে ১৩.৭৬ জন। এই হিসাবে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩.১৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৪.৮৭ শতাংশ। অক্টেবর মাসে ১৪৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত হয়েছিল। নভেম্বর মাসে ১৫৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৮৪ জন। এই হিসেবে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বর মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৯.৭২ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১০.১৭ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৩৩৪ জন, অর্থাৎ ৮০.৮৭ শতাংশ।
ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। পথচারী নিহতের মাত্রাও চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার উর্ধমুখী হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।