| |
               

মূল পাতা স্বাস্থ্য বাংলাদেশে ডেঙ্গুর টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত কখন হবে?


বাংলাদেশে ডেঙ্গুর টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত কখন হবে?


স্বাস্থ্য ডেস্ক     31 July, 2023     11:17 AM    


ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, সেখানে কার্যকর ফলাফল পাওয়া গেলে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলেই বাংলাদেশে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন পরিচালক ডা. শাহাদাত হোসেন নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানিয়েছেন। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। আপনারা জানেন, একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কিছু দেশে এটি অনুমোদন পেয়েছে। সেই দেশগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে, আমরা সাধারণত যখন ডব্লিউএইচও যখন অনুমোদন দেয়, তারপরে আমরা শুরু করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর টিকার কার্যকারিতা নিয়ে নানা মহলে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে। ’সেই হিসাবে এটা যদি সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের জন্য কার্যকরী হয়, সেই বিষয়টা মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিবেচনাধীন আছে। ডব্লিউএইচও (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) সঙ্গে এ বিষয়ে আমাদের যোগাযোগ আছে।

যুক্তরাষ্ট্রে গতবছর সানোফি এবং লুই পাস্তুর ইন্সটিটিউট মিলে ডেংভাক্সিয়া নামের একটি টিকার অনুমোদন দেয়া হয়। ফিলিপিন্স, পুয়ের্তো রিকো কয়েকটি দেশে এই টিকার প্রয়োগ করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) পরামর্শ দিয়েছে, নয় থেকে ১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে যারা এর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, শুধুমাত্র তাদের এই টিকা দেয়া যাবে। এর বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এই টিকার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি। তবে সিঙ্গাপুরে এই টিকাটি ১২ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, এই টিকার সমস্যা হলো, যাদের আগে ডেঙ্গু হয়নি, তাদের এটি দেয়া হলে ব্যাপক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাই পরবর্তীতে ফিলিপিন্স এবং মালয়েশিয়ায় এটি নিষিদ্ধ করা হয়। গত বছরের শেষ দিকে জাপানের তাকিদা কোম্পানি একটি ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কার করেছে, যার নাম কিউডেঙ্গা। চার বছরের পর থেকে সবাইকে এই টিকা দেয়া যেতে পারে। কিউডেঙ্গা টিকাটি ডেঙ্গুর চার ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে দেখা গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় এটা ব্যাপক ভিত্তিতে দেয়া শুরু হয়েছে। সেখানে এটির দুই ডোজের খরচ পড়ে ৮০ ডলার। আমার পরামর্শ হচ্ছে, টিকার ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। যদি দেখা যায় যে, এটা ভালো ফল দিচ্ছে, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই এবং কম দামে পাওয়া যায়, তাহলে আগামী মৌসুম থেকে আমরা এই টিকা দেয়ার কথা ভাবতে পারি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ডেংভাক্সিয়া টিকা অনুমোদন পেয়েছে। ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে অন্য পাঁচটি টিকা এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে জাপানের তাকিদা কোম্পানির কিউডেঙ্গা আর ব্রাজিলের ইন্সটিটিউট বুটানটান আর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের যৌথ উদ্যোগের টিকা বুটানটান-ডিভি। তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় বিভিন্ন দেশে অনেক মানুষকে টিকা দিয়ে কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। সেখানে সফলতা আসলে এবং নিরাপদ বলে প্রমাণিত হলে সেসব টিকার অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় ১১টি দেশে এসব টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।

জুলাই মাসে সাতগুণ বেশি রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, জুন মাসের তুলনায় শুধুমাত্র জুলাই মাসে সাতগুণ বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগরে আক্রান্ত হয়েছে ১,১৪৩ জন এবং ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছে ১,০৫৯ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্ত হয়েছে ২,২০২ জন। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। বিশেষজ্ঞরা জুলাই মাসের শুরুর দিকেই সতর্ক করে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারীর দিকে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশি হাসপাতালগুলোয় এখনো প্রতিদিনই অসংখ্য রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। অনেক হাসপাতালে শয্যা না থাকায় রোগী ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

একজন ডেঙ্গু রোগীর স্বজন মনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার ভাইকে প্রথমে নিয়ে গেছি মুগদা হাসপাতালে, সেখানে নাকি সিট নেই বলে ভর্তি করেনি। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসছি। এর মধ্যেই বাবার অবস্থা অনেকখানি খারাপ হয়ে গেছে।

তবে চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে ধারন ক্ষমতার তুলনায় রোগী এখন অনেক বেশি। তাই বাধ্য হয়ে কম অসুস্থ রোগীদের তারা বাড়িতে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসক বলেছেন, প্রতিদিন অনেক রোগী আসছে। কিন্তু এতো রোগীকে দেয়ার মতো শয্যা তো আমাদের এখানে নেই। তাই অনেককে আমরা বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিতে বলছি। তবে গুরুতর রোগীদের জন্য যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করা হচ্ছে।‘’

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় ৮ হাজার ৯৬১ জন রোগী ভর্তি রয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি যেসব হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য বিভাগ তথ্য সংগ্রহ করে থাকে, শুধুমাত্র সেই তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসাব করা হয়েছে।

যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বাড়িতে থেকে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন অথবা যেসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের তথ্য স্বাস্থ্য বিভাগের আসছে না, সেসব তথ্য বিবেচনায় নিলে এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ এই বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, ডেঙ্গুর বাহক যে এডিস মশা, তাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়,তাহলে তো ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটতেই থাকবে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের জন্য সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে যে একটি সুসমন্বিত অভিযানের দরকার, সেটা আসলে পরিকল্পনাও করা হয়নি, শুরুও করা হয়নি। যে ওষুধ, মাঠ পর্যায়ে সেটা কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ’সব মিলিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার, ডেঙ্গুর বাহক যে এডিস মশা, সেটা দমন বা নির্মূল করার ব্যর্থতার জন্যই মূলত ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধের দুটি পথ আছে। একটি হচ্ছে, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা, আরেকটি হচ্ছে, যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আক্রান্তদের কামড়ে মশা যাতে এই রোগ অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারে, সেই ব্যবস্থাও করা করতে হবে।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এখন মশা মারা বা প্রজনন স্থান ধ্বংস করার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব হচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ইত্যাদির। আর চিকিৎসার দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের। এই দুইয়ের মধ্যে একটি সমন্বয় থাকা দরকার। কিন্তু শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই দুইয়ের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতার রয়েছে।‘

বছরের শুরুতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সতর্ক করে দিয়েছিল, এই বছর ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়তে পারে। কিন্তু সেই সতর্কবার্তা কোন সিটি কর্পোরেশন বা স্থানীয় সরকারের কোন বিভাগ আমলে নেয়নি বলেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যার কারণে ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার হয়েছে।

২৫ থেকে ৪০ বছরের মানুষ কেন বেশি আক্রান্ত?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, এই বছর ডেঙ্গুতে ২৫ থেকে ৪০ বছরের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এর ব্যাখ্যা হিসাবে ডা. লেলিন চৌধুরী মনে করেন, এই বয়সের মানুষ বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারের মূল অর্থ উপার্জনকারী হওয়ায় তারা অসুস্থ হলে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। এই কারণে এদের তথ্য বেশি আসছে। কিন্তু অনেক শিশু ও বয়স্ক মানুষরাও আক্রান্ত হচ্ছে বলে তারা দেখতে পেয়েছেন। অনেক বয়স্ক মানুষকে দেরিতে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসছে। শিশুদের মধ্যেও আমরা অনেক আক্রান্ত দেখতে পাচ্ছি। যেমন ডেঙ্গুর কারণে অনেক শিশুর ডায়রিয়া হচ্ছে, কিন্তু শুধু ডায়রিয়ার জন্য কেউ তো শিশুদের নিয়ে হাসপাতালে আসে না। এ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।