| |
               

মূল পাতা ইসলাম বিশ্বনবী ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ


বিশ্বনবী ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ


মুফতী মোহাম্মদ এনামুল হাসান     13 October, 2022     07:13 AM    


আরবি হিজরী সনের তৃতীয় মাস রবিউল আওয়াল। রবিউল আওয়াল মাস মুসলিম মিল্লাতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফযিলতের মাস। কারণ এ মাসেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরাতে শুভাগমন করেন এবং ওফাত লাভ করেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক সময় দুনিয়াতে শুভাগমন করেন যখন দুনিয়াব্যাপী ছিল গোমরাহি, পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ ক্বাবা শরিফ ধ্বংস করার জন্য আসহাবে ফিল (হস্তী বাহিনী) আক্রমণ করে। ঐ বছর রবিউল আওয়াল মাসে ১২ তারিখ সোমবার দুনিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য দিন। কারণ ঐ দিনই হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মগ্রহণ করন। হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মের পূর্ব থেকেই এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে, যা ছিল মূলত হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বাভাস।

হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মের পূর্বে পারস্য দেশে কিসরার রাজপ্রসাদে এক কম্পন অনুভূত হয়। যার ফলে প্রসাদের ১৪ টি গম্বুজ ধ্বংস হয়ে যায়। পারস্যের যে অগ্নিকুণ্ড ১ হাজার বছরে কখনো নির্বাপিত হয়নি তা নিজে নিজেই নিভে যায়। হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতৃগর্ভ থাকাকালীন ই মা আমিনা স্বপ্নে দেখেন যে, একজন ফেরেশতা এসে তাকে বলছেন, তোমার গর্ভে থাকা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার নাম যেন আহমদ রাখা হয়। এজন্য মা সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর নাম রাখলেন আহমদ। দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার প্রিয় পৌত্রের নাম রাখলেন মুহাম্মদ।

জন্মের পর প্রথম সাতদিন আবুলাহাবের আযাদকৃত দাসী সুওয়াইবা হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুধ পান করান। জন্মের অষ্টমদিন আরবের অভিজাত বংশের প্রথা অনুযায়ী তাকে ধাত্রী হালিমা সাদিয়ার হাতে অর্পণ করা হয়, যেন তিনি তাকে স্তন্যপান করান এবং লালন পালন করেন। শিশু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবের অন্যান্য শিশুদের থেকে সম্পূর্ণ সতন্ত্র ছিল। খেলাধুলা বা অহেতুক সকল কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন।শুধু বিরত ই রাখতেন না বরং এ সকল কর্মকাণ্ড থেকে এড়িয়ে থাকতেন।

হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র বিশ্বের মানবজাতির পথ প্রদর্শকের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তিনি সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একমাত্র আদর্শরুপে আগমন করেছেন।মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের ফর্মুলা তিনি বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ঘরের কাজ নিজেই করতেন, বাজার থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে আসতেন, জুতা ছিড়ে গেলে নিজেই তা সেলাই করতেন, নবী হিসেবে প্রধান সংস্কারক, প্রধান বিচারক, প্রধান সমরনায়ক, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, আদর্শ ব্যবসায়ী, আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে যাবতীয় মানবীয় গুণাবলীর বিপুল সমাবেশ হয়েছিল।

সীমাহীন গুণাবলীর অধিকারী হয়ে ও তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন।সামান্যতম অহংকার কিংবা বড়ত্ব তার মাঝে ছিলনা। একবার এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  দরবারে উপস্থিত হলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখামাত্র লোকটি কাপতে লাগলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অভয় দিয়ে বললেন,ভীতসন্ত্রস্ত হয়োনা। আমি কুরাইশ বংশের এক মহিলার পুত্র মাত্র।যিনি শুকনো গোশত পাক করে আহার করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা এক আল্লাহর এবাদত করিবে,তার সাথে কাউকে শরিক করবেনা, তিনি আরো নির্দেশ দিয়েছেন পরোপকারের,সার্থপরতা পরিহার করার,তিনি তার আদর্শের দ্বারা এমন এক সোনালী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, সুবিচার, পরস্পরে সহানুভূতি এবং মমত্ববোধ। যার কারনে তার জীবদ্দশায় বিশৃঙ্খলতায় জর্জরিত আরব হয়ে উঠে সম্প্রীতি ও শান্তির প্রতীক।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে জুলম অত্যাচার বড় পাপকার্য। অত্যাচারিত মজলুম, অসহায় মানুষদের সাহায্য করা হুজুরসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এক মহান এবাদত। তৎকালীন আরবজাতি তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার জন্য জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকতো। তাকে ভালোবাসতো পাগলের মতো। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দশ বৎসরের খাদেম হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি দেখেছি, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চুল মোবারক যখন কাটা হতো, সাহাবায়ে কেরাম তখন তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। একটি চুল মাটিতে পড়া মাত্র তারা দ্রুতবেগে তা তুলে নিতেন এবং বরকতের জন্য তা তাদের নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। অধিনস্থদের প্রতি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যবহার ছিল অতি উত্তম। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,আমি প্রায় দশ বছর হুজুরের খেদমত করেছি।আল্লাহর শপথ, আমি বাড়ীতে অথবা সফরকালে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  যে পরিমাণ খেদমত করেছি,তার চেয়ে অধিক খেদমত হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার করেছেন। দশ বৎসর যাবত খেদমতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসন্তুষ্ট হয়ে উহ শব্দটি পর্যন্ত করেন নি।কোন সময় যদি কাজ করতে ভুলে যেতাম তাহলে তিনি বলেননি যে একাজটি কেন করনি।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে কিভাবে জীবন যাপন করেছেন, তার জীবন পরিচালনার পদ্ধতি কিরুপ ছিল, পারিবারিক জীবনে তিনি কেমন ছিলেন,স্ত্রীদের সাথে তার ব্যবহার কেমন ছিল, সবকিছু ই আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের আমলের আমলের সুবিধার্থে সংরক্ষণ করে রেখেছেন সাহাবায়ে কেরামদের মাধ্যমে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  এমন অদ্বিতীয় ব্যক্তি যার বংশ তালিকা ও আমাদের মাঝে সংরক্ষিত। তার বংশের তালিকা হলো- মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম ইবনে আব্দে মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররাহ ইবনে কা'ব ইবনে লুআই ইবনে গালেব ইবনে ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নযর ইবনে কিনানা ইবনে খুযাইমা ইবনে মুদরিকাহ ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুযার ইবনে নাযযার ইবনে মা'বাদ ইবনে আদনান। এ পর্যন্ত সমস্থ ইতিহাসবিদ একমত তাই এর পর মতবিরোধ থাকায় সতর্কতা অবলম্বনে আর না লেখায় উত্তম।

শুধু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  বংশ তালিকা ই নয় বরং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাগলগুলোর নাম এবং উটগুলোর নাম ও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নয়টি ছাগল ছিল যা থেকে দুধ সংগ্রহ করা হতো। উক্ত ছাগল গুলোর নাম হলো- আজওয়াহ, সাকিয়্যাহ,যমযম, বারাকাহ, ওয়ারাছাহ, ইতলাল, আতরাফ, গীফাহ, ও উমরাহ।এই নয়টি বকরি ছিল। আর একটি পুরুষ ছাগল ছিল। যার নাম ইউমন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উট গুলোর নাম হলো আদবা, শাহবা, জাদআ ও কাসওয়া। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুটি খচ্চর ছিল যার নাম দুলদুল ও আফীর। তার বাহন যে গাধা বহন করতো তার নাম ইয়াফুর। যে সকল ঘোড়ার উপর তিনি আরোহণ করতেন তা হলো সাকাব,সাবহা, লাহীফ ও তাররায।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র আল কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেছেন, হে নবী! আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও তাহলে আমার (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদিগকে ভালবাসবেন। আর আল্লাহ তোমাদের গুনাহ সমূহকে ক্ষমা করে দিবেন কারণ আল্লাহ তায়ালা ই একমাত্র ক্ষমা প্রদর্শনকারী। [আল কুরআন]।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  বলেন, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মু' মিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা,মাতা,ছেলে,মেয়ে এবং সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় ও ভালবাসার না হয়ে উঠবো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যদি ভালবাসার সম্পর্ক থাকে তাহলে কিয়ামতের দিন তার সাথেই হাশর হবে। বুখারি শরিফে এক হাদিসে আছে যে, এক সাহাবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! কিয়ামত কবে হবে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে পালটা প্রশ্ন করে বললেন, কিয়ামত কবে হবে জিজ্ঞাসা করছো, কিয়ামতের জন্য তুমি কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ? উত্তরে সে বলল নামাজ রোযা একটা তেমন বেশি আমার নেই, কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাকে বললেন, যে যাকে ভালোবাসে, তার সাথে তার হাশর হবে।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। রুপ সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। চারিত্রিক মাধুর্যতায় তার আসন সকলের উপরে। বিশ্বব্যাপী আজ দাবানলের মতো দাউদাউ করে অশান্তির আগুন জ্বলছে।কোথাও আজ শান্তির লেশমাত্র নেই।মানুষের জান- মালের নিরাপত্তা নেই। মারামারি, কাটাকাটি নিত্যদিনের সঙ্গী। দুনিয়াব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের সকলকে বিশ্বনবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  আদর্শ ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্থরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর বিকল্প কোন ব্যবস্থাই দুনিয়াবাসীকে শান্তি দিতে পারবেনা।

লেখক : নাজিমে দারুল ইকামাহ, জামিয়া কোরআনিয়া সৈয়দা সৈয়দুন্নেছা ও কারিগরি শিক্ষালয় কাজীপাড়া, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া