ইশতিয়াক হাসান 03 May, 2021 04:53 PM
মধুপুরের জলছত্র মিশনের নাম শুনলেই শিহরণ জাগে শরীরে। যদিও এখন ওই এলাকা ঘুরে আনারস বাগান ছাড়া পাবেন না কিছুই। আমাকে টানে পঞ্চাশ বছর কিংবা তারও আগের, পুরনো সেই জলছত্র মিশন। যেখানে ছিল বাঘ-চিতার আড্ডাখানা।
স্বাধীনতার বছর কয়েক আগের ঘটনা। জলছত্র মিশনের দক্ষিণের পাকা রাস্তা। ধারেই বিশাল এক বট গাছ। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। প্রবল গরমে প্রাণ জায়। ত্যক্তবিরক্ত একটা চিতা বাঘ বটের মোটা একটা ডালে চড়ে বসল। একটু বাতাস বইতেই আয়েস করে গা এলিয়ে দিল। শান্তিতে চোখ বুজে এল। তবে সুখ কপালে সইলো না। মধুপুরের হাটুরেদের একটি দল ওদিক দিয়ে যাচ্ছিল। ওরা ওটাকে দেখে ফেলল।
হাটুরেরা খবর দিল শিকারি মনসিনিয়র মাইকেল ডি'কস্তাকে। চিতাটা বেশ দূরে। তারপরও লোকজনের পীড়াপীড়িতে গুলি করলেন। কপাল ভালো চিতাটার। গুলিটা লাগল, ও যেখানে বসেছিল তার একটু নিচে। নিঃশব্দে গাছ থেকে নেমে ঝোপের আড়াল নিয়ে লোকজনের নাগালের বাইরে চলে গেল সে।
বায়জীদ খান পন্নীর 'বাঘ-বন-বন্দুক' বইয়েও মধুপুর এলাকায় চিতা বাঘ শিকারের কাহিনি আছে। মধুপুরের জঙ্গলে বাঘ ছিল সম্ভবত ১৯৬০-এর আশপাশ পর্যন্ত। তবে চিতা আরো কিছুটা বেশি দিন টিকেছিল।
জানা মতে, মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরও ওদের কালেভদ্রে দেখা মিলত। নিদেন পক্ষে রাতে শোনা যেত রোমহর্ষক সেই করাত চেরা ডাক।
দিবা স্বপ্ন দেখি হয়তো পরের আরো অনেকগুলো বছরও চিতারা ছিল ওখানে। ধূর্ত জন্তুগুলো হিংস্র দু-পেয়েদের ফাঁকি দিয়ে বেঁচে থাকার কৌশল শিখে ফেলেছিল। এক সময়ের শিকারী সরওয়ার পাঠান ভাই এখন পুরোদস্তুর বন্যপ্রাণীপ্রেমী। তার কাছে শুনেছিলাম আশ্চর্য এক গল্প। ওটা অন্তত বছর পঁচিশেক আগের কাহিনি। এর বেশ কতকটা সময় আগে মধুপুর এলাকা থেকে বিদায় নিয়েছে গড়ের রাজা চিতা বাঘ। তো গাজীপুরের জঙ্গলের ধারের এক বাড়িতে যেতেন তিনি প্রায়ই। ওরা জাল দিয়ে মেছো বাঘ ধরত। ওই বাড়ির লোকেরাই বলত বিশাল এক মেছো বাঘের গল্প। ওটা খুব ধূর্ত ছিল। জালে ধরা পড়ত না কখনো। আমার নিজের সন্দেহ ওটা হয়তো আদপে মেছো বাঘই ছিল না, ছিল মেছো বাঘের ছদ্মবেশে টিকে থাকা গড়ের শেষ চিতা বাঘ!
তবে আমার মত বড় আশাবাদী এবং কল্পনাপ্রবণ মানুষও জানি মধুপুরে চিতা বাঘ নেই আর। তেমনি জঙ্গলটাকে ছোট করে, চারপাশে বসতি করে মানুষ এমন অবস্থা করেছে, এখানে আশ্চর্য সুন্দর জন্তুটিকে ফিরিয়ে আসার সুযোগও কম।
তবে মধুপুর থেকে চিতা হারিয়ে যাওয়াই শেষ কথা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বন-পাহাড়ে এখনো হঠাৎ হঠাৎ মেলে চিতার খবর। শিকারীদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে এখনো টিকে আছে ওরা। সাম্প্রতিক ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে একটিকে। সুপ্রিয় চাকমা, শাহরিয়ার সিজার রহমানদের গবেষণা, ক্যামেরা ট্র্যাপও নিশ্চিত করছে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তত কয়েকটি এলাকায় চিতা বাঘের আলাদা বসতি আছে। যদিও কোনোখানেই সংখ্যাটি বেশি নয়।
আশাবাদী হওয়ার জায়গা আছে আরো। চা-বাগান, ভারতীয় সীমান্তঘেরা সিলেট বিভাগের জঙ্গলগুলো থেকেও কখনো-সখনো পাই চিতার খবর। এমনকী রোহিঙ্গায় বিপর্যস্ত কক্সবাজারে দু-চারটি হলেও হয়তো আছে। অতি আশাবাদী হয়ে বিশ্বাস করতে চাই চট্টগ্রাম জেলার দু-একটি বন এবং ভারতের সীমান্তঘেঁষা শেরপুর-নেত্রকোনা-জামালপুরেও এদের ছোট ছোট বসতি থাকতে পারে।
একই সঙ্গে ভয়াবহ একটা আশংকায়ও কেঁপে ওঠে বুক। পার্বত্য চট্টগ্রামের চিতা বাঘ অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় চলছে সমানে গাছকাটা, বন্যপ্রাণী শিকার। চিতার অন্য বসতিগুলোও আছে বিপদে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের বনবিভাগ প্রতিটি জঙ্গলে চিতা বাঘের সংখ্যা জানে। আর আমাদের চিতা বাঘ নিয়ে একটি জরিপও হয়নি এখন পর্যন্ত। এত্তো চমৎকার একটি প্রাণী, কিন্তু কী অবহেলা!
আজ ৩ মে, বিশ্ব চিতা বাঘ দিবস। এই দিনে একটাই চাওয়া। সঠিক জরিপ করে বাংলাদেশের অন্তত পাঁচটি অরণ্যকে ল্যাপার্ড রিজার্ভ বা চিতা বাঘের অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হোক। তাহলেই হয়তো অদ্ভুত সুন্দর জন্তুটিকে রক্ষা করতে পারব আমরা।