মূল পাতা বিশেষ প্রতিবেদন যে যুদ্ধে বাঙালি সেনাদের বীরত্বে কেঁপে উঠেছিল ভারত!
শেখ আশরাফুল ইসলাম 05 December, 2024 09:25 AM
কাশ্মিরে নিজেদের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে দেশ ভাগের মাত্র দুই মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়ায় ভারত। পরে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধের সাময়িক অবসান হলেও এর রেশ রয়ে যায়। পরে ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে দ্বিতীয় বারের মতো মুখোমুখি হয় এই দুই দেশের সেনারা।
ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালের এ যুদ্ধে বাঙালি সেনাদের অসাধারণ ভূমিকা সংরক্ষিত রয়েছে ইতিহাসের সোনালি পাতায় ।
সেই সময় পাকিস্তানের ৮ টি ডিভিশনের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সংগঠিত হয়েছিল মাত্র ৪ টি ব্যাটেলিয়নের মাধ্যমে। এর অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল আতিক হক। মাত্র এই ৪ টি ব্যাটেলিয়ন নিয়ে যুদ্ধে দক্ষতার সাথে ভারতীয় বাহিনীর মোকাবিলা করেন তিনি। ফলে যুদ্ধের পর পাকিস্তান সর্বোচ্চ সামরিক পদক প্রদান করেন লে. কর্নেল আতিক হককে।
আগস্ট মাস থেকেই শুরু হয়েছিল যুদ্ধ। পরে আমেরিকার পরামর্শে আনু্ষ্ঠানিকভাবে ৬ সেপ্টেম্বর যুদ্ধে জড়ায় ভারতীয় বাহিনী। এ সময় বাঙালি সেনাদের কৌশলগত আক্রমণের মুখে লাহোরের উপকণ্ঠে এসে থেমে যেতে বাধ্য হয় ভারতীয় বাহিনী। লাহোর প্রতিরক্ষার সেই যুদ্ধ ছিল আধুনিক যুগে বাঙ্গালি সেনাদের অংশ নেওয়া প্রথম সক্রিয় ও সর্বাত্মক যুদ্ধ। এর আগে বাঙালিদের দেখা হতো নন-মার্শাল রেস (অযোদ্ধা জাতি) উদ্ভূত সৈন্য হিসেবে।
সে যুদ্ধে পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান পাওয়া প্রায় প্রত্যেক সমরনায়কই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, আবুল মনজুরসহ প্রত্যেকেই বীরত্ব দেখান।
৪৬৬ জন সৈন্যের একটি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেই বাহিনীই প্রথম ভারতীয় বাহিনীর সামনে পড়ে। তাজুল ইসলাম নামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন এনসিও নিজের বুকে মাইন বেঁধে আগুয়ান ভারতীয় ট্যাংক বহরের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেন।
জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক “হিলাল-ই-জুররাত” লাভ করেন। তার ইউনিট তিনটি তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক “সিতারা-ই-জুররাত” ও নয়টি চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক পদক “তমঘা-ই-জুররাত” অর্জন করে।
স্থলবাহিনীর পাশাপাশি বিমানবাহিনীতে কর্মরত সেনারাও ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশ কৃতিত্ব দেখান। এক্ষেত্রে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে বৈমানিক মুহাম্মাদ মাহমুদুল আলমের নাম । একটি হীনবল এফ-৮৬ স্যাবর জঙ্গিবিমান দিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথম মিনিটেই পাঁচটি ভারতীয় হকার হান্টার বিমান ভূপাতিত করে সর্বকালের সেরা রেকর্ড গড়েন বিমানযুদ্ধের ইতিহাসে। যার মধ্যে প্রথম চারটি ভূপাতিত করেন মাত্র ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে। এটি আজ পর্যন্ত একটি বিশ্বরেকর্ড। পুরো যুদ্ধে তিনি মোট নয়টি ভারতীয় জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেন।
২০১৪ সালে মুসলিম এই বীরের নামেই পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালী বিমানঘাঁটির নামকরণ করা হয় “পিএএফ বেস এম এম আলম”। ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালের সেই যুদ্বের পর তাকে ঢাকায় একটি বাড়ি উপহার দেয় “ঢাকা মিউনিসিপালটি করপোরেশন”।
বিশ্বের ২২ জন লিভিং ঈগলের একজন আরেক বাঙালি বৈমানিক সাইফুল আজম বীরত্বের সাথে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাথে ডগফাইট করে একটি জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করেন।
পরবর্তীতে সাইফুল আজম ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধেও অংশ নেন। সেখানেও তিনি ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিমানবাহিনীর ত্রাসে পরিণত হন। তিনি যতগুলো ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করেন তা আজও রেকর্ড হয়ে আছে। আজ পর্যন্ত অন্য কেউ একা এতগুলো ইসরাইলি বিমান ধ্বংস করতে পারেনি। সাইফুল আজম বিশ্বের ২২ জন লিভিং ঈগলের একজন বলে বিবেচিত।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ বাঙালি অফিসারই বীরত্ব পদক লাভ করেন।
পশ্চিমা শক্তি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে ১৭ দিনের মাথায় সেই যুদ্ধ শেষ হয়। তবে সামগ্রিকভাবে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে কিছুটা এগিয়েছিল ভারত। পরবর্তীতে সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি সামনে রেখে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবলভাবে জাগ্রত হয় আইয়ুববিরোধী চেতনা।