মূল পাতা বিশেষ প্রতিবেদন হেফাজতের ব্যানারে রাজনৈতিক দল; আলোচনা-সমালোচনার ঝড়!
শেখ আশরাফুল ইসলাম 06 October, 2024 10:59 PM
সাম্প্রতি কিছু আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও কমিটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ব্যাপক সম্পৃক্ততা রয়েছে সংগঠনটির। বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী হচ্ছে সমালোচনা । সেই সাথে আলোচনা হচ্ছে সংগঠনটি ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার হয়ে উঠছে কিনা!
শনিবার ৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেয় হেফাজত ইসলাম। প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক দল না হওয়া সত্বেও কেন ডাক পেয়েছে হেফাজতে ইসলাম ।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে হেফাজত ও খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা আহমদ আলী কাসেমীর সাথে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র ইসলামি আন্দোলন ব্যাতিত ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্য কোন দলকে পৃথকভাবে আমন্ত্রণ জানায়নি অন্তর্বর্তী সরকার। হেফাজতে ইসলামকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। হেফাজত মহাসচিব শায়খ সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা সেই ব্যানারেই বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত হয়েছিলাম।
এর পেছনে কারণ কী-জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো মনে করেছে, হেফাজতের সাথে সব ইসলামি দলই যেহেতু আছে, তাই আলাদাভাবে কাউকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে হেফাজতকে আমন্ত্রণ জানালেই হয়ে যাবে। সরকারের উচিত ছিল স্বতন্ত্রভাবে নিবন্ধিত ইসলামি দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শীর্ষ ইসলামি নেতা বলেন, যদি ইসলামি রাজিনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ্য করেই হেফাজতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে খেলাফত আন্দোলনের আমীর আল্লামা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমীর হওয়া সত্বেও এই দলটিকে কেন জানানো হয়নি? এটা তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ও হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী সংলাপ প্রসঙ্গে বলেন, বিষয়টি আমরা প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। হেফাজত অরাজনৈতিক একটি সংগঠন। এটি সরকারের অদূরদর্শিতা বলা যায়।
এদিকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জের সিংগাইরে সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গণসমাবেশ করে হেফাজত। সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব। বক্তৃতার সময় তিনি হেফাজতের আরেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবিকে এমপি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা।
এই প্রসঙ্গে হেফাজতের নায়েবে আমীর মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, হেফাজত অরাজনৈতি সংগঠন। তবে আমরা ইসলামি রাজনীতিকে সমর্থন করি। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হয়তো মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব এমনটি বলেছেন। তবে সংগঠনের পক্ষ থেকে এটি কোনভাবেই কাম্য নয়।
তবে এই প্রসঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ও হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী কথা বলেন ভিন্ন সুরে। তিনি বলেন, হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। একটা অরাজনৈতিক সংগঠনের গণসমাবেশ থেকে দেশবাসী এমন বক্তব্য আশা করেনি। এটি নিয়ে নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে হেফাজত এই বিষয়ে সতর্ক থাকবে।
হেফাজতের মিটিংয়ে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবের সেই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে জানিয়ে মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী বলেন, সেদিনের সেই বক্তব্য হেফাজতের সাংগঠনিক বক্তব্য নয়। মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব যেটি বলেছেন, তার দায় তাকেই নিতে হবে। তাছাড়া সেই ঘটনার পর হেফাজতের কোন মিটিং হয়নি। আশাকরি মিটিং হলে এই বিষয়ে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।
এছাড়া হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিপরিতে বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ প্রাধান্য পাচ্ছেন। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মজলুমদের বিষয়টি খেয়াল করা হচ্ছে! যারা ফেসিস্ট সরকারের আমলে নির্যাতিত, তারাই অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে হেফাজতের তৃণমূল কমিটিতে। তবে অরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিপরিতে ইসলামি রাজনৈতিক দলের কেউ স্থান পেয়ে থাকলে বিষয়টি মহাসচিব দেখবেন।
কমিটি গঠনে ইসলামি রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিয়ে হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী বলেন, আমার মতামত হচ্ছে সংগঠনে অতিতের অবদানকে সামনে রেখে প্রত্যেককে মূল্যায়ন করা উচিত, কোন রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে না। তবে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা যেভাবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছে, সেভাবে তৃণমূল কমিটিতেও থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে যারা অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তারা অবহেলিত হবে, এটি আমি মনে করি না।
হেফাজতের কমিটি গঠনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কোন সিন্ডিকেট রয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির যুগ্ম-মহাসচিব ও হেফাজত নেতা মাওলানা জালালুদ্দিন বলেন, কমিটি গঠনের জন্য একটা সাব কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন আছেন। কিন্তু উনারা অনেক যায়গায় যান না। মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও মাওলানা মনির হুসাইন কাসেমী যান। অতএব বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সিন্ডিকেট কায়েম করেছে এই কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তিনি বলেন, হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু আপনি খেয়াল করে দেখবেন কর্মসূচিগুলো রাজনৈতিক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ অনেক ইসলামি দলের নেতারা আছেন। সেই প্রেক্ষিতে জেলা কমিটিতেও ইসলামি দলের নেতারা থাকতে পারে। তবে তার মানে এই নয় যে, যারা অরাজনৈতিক তাদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এদিকে হেফাজতের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠবে কিনা এবং অদূর ভবিষ্যতে দেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম তার নিজস্বতা হারাতে পারে কিনা সেটি নিয়ে কথা হয়েছে অনলাইন এক্টিভিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাওলানা রুহুল আমীন সাদীর সাথে। তিনি মনে করেন, মুসলমানরা হেফাজতকে তার নিজস্ব যায়গায় দেখতে চায়। মনে রাখতে হবে, হেফাজত মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আস্থার যায়গা। একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এটি নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। হেফাজত একটা পলিটিক্যাল পার্ট হোক, এটা কেউ চায় না।
তিনি বলেন, শাপলার শহীদদের তালিকা প্রকাশসহ সংগঠনটির অনেক কাজ এখনো বাকী আছে। এগুলো কেন দেরি হচ্ছে বা হচ্ছেই না, সেদিকে তাদের নেতৃবৃন্দের মনোযোগ দেওয়া দরকার।