| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক বাইডেন-শি বৈঠক থেকে যে ৪ বিষয় জানা গিয়েছে


বাইডেন-শি বৈঠক থেকে যে ৪ বিষয় জানা গিয়েছে


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     16 November, 2023     06:48 PM    


যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠক হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকের ফলাফল নিয়ে প্রত্যাশা কমই রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তারপরও বুধবার ওই বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমঝোতা হয়।  বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, এবারে আমাদের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমার ধারণা যেগুলো খুবই গঠনমূলক এবং ফলপ্রসূ ছিল। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। এর আগে স্বীকার করে প্রেসিডেন্ট শি বলেন, মার্কিন-চীন সম্পর্ক কখনোই মসৃণ ছিল না। তবে, দুই পরাশক্তির, একে অপরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কোনো অপশন হতে পারে না। ক্যালিফোর্নিয়ায় এই দ্বিপক্ষীয় আলোচনা থেকে মূলত চারটি বিষয় জানা গিয়েছে।

১. জলবায়ু ইস্যুতে ঐকমত্য
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী এই দুই দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরো পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়ে তারা কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তারা মিথেন নির্গমন কমিয়ে আনার ব্যাপারে একে অপরকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মিথেন হল এক ধরণের শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস। দেশ দুটি ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে তিনগুণ বাড়ানোর বৈশ্বিক প্রচেষ্টার প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে।বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই মাসের শেষের দিকে দুবাইতে যে জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেই সম্মেলনের আগে এটি এক ধরণের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

যুক্তরাজ্যের থিংক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের ফেলো এবং চীন-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বার্নিস লি বলেছেন, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

মিথেন চুক্তিকে একটি প্রধান পদক্ষেপ বলে অভিহিত করে ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউটের ডেভিড ওয়াসকো বলেন, চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিথেন নিঃসরণকারী দেশ এবং এই গ্যাসের নিঃসরণ রোধে বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অল্প সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর জন্য অপরিহার্য।

২. ফেন্টানাইল পাচার রোধ
দুই পক্ষ বলেছে যে তারা মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এতে অপরকে সাহায্য করবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ ফেন্টানাইলের জোয়ার রোধ করার জন্য রাসায়নিক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এই উপাদানটি অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণের ফলে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেড়ে গিয়েছে। গত বছর প্রায় ৭৫ হাজার মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর পেছনে কারণ ছিল এই শক্তিশালী সিনথেটিক ওপিওড বা কৃত্রিম ওপিওড। কৃত্রিম ওপিওড হল এমন পদার্থ যা পরীক্ষাগারে সংশ্লেষিত হয় এবং যেটি মস্তিষ্কের সেই একই অংশে প্রভাব ফেলে যেমনটা কিনা প্রাকৃতিক ওপিওড যেমন, মরফিন, কোডাইন করে থাকে। এগুলো মূলত বেদনানাশক বা ব্যথা উপশমে কাজ করে। চীনা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র এই ওষুধেই উৎপাদন করে না বরং ওষুধগুলো তৈরি করার জন্য যেসব রাসায়নিকের প্রয়োজন হয় সেগুলোর উৎসও এই কোম্পানিগুলো।

ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের আন্তর্জাতিক সংগঠিত অপরাধ বিশেষজ্ঞ ভান্ডা ফেলবাব-ব্রাউন বলেছেন, চুক্তিটি মূলত এক ধরণের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিবৃতি, তবে এর প্রকৃত প্রভাব কেমন হবে সেটি নিয়ে এখনও প্রশ্ন থেকে গিয়েছে। চীন এই কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আদৌ কী ব্যবস্থা নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়, তারা কি অন্তত তিনটি কোম্পানির পেছনে লাগবে? নাকি পাঁচটি? পঞ্চাশটি? তার ধারণা চীন সম্ভবত মাদক বিরোধী সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবকে, তাদের বৃহত্তর কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার জন্য একটি দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকবে। চীন যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি চালান বন্ধ করে দিয়েছে, যার অর্থ বেশিরভাগ অবৈধ বাণিজ্য মেক্সিকো রুট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, চীন এ ধরনের পাচার বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে চীনের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রে যে ওপিওড মহামারী দেখা দিয়েছে, এর পেছনে কেবল যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী।

৩. সামরিক যোগাযোগ পুনস্থাপন
দুই দেশ একে অপরের সাথে সামরিক যোগাযোগ পুনরায় শুরু করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে – এটি এমন একটি পদক্ষেপ যা আমেরিকানদের প্রত্যাশার তালিকার উপরের দিকে ছিল। গত বছর মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করার পর চীন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি সন্দেহভাজন চীনা গুপ্তচর বেলুন উত্তর আমেরিকার আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। পরে যুক্তরাষ্ট্র সেগুলো গুলি করে আটলান্টিক মহাসাগরে নামিয়ে আনে। ওই ঘটনার পর থেকে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো অবনতি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপ-সহকারী সচিব মিক মুলরয় বলেছেন, স্নায়ু যুদ্ধের সময়, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সবসময় পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর সাথে সামরিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। যাতে পারমাণবিক শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধের কারণ হতে পারে এমন যেকোনো দুর্ঘটনা বা ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যায়। এটি এখন চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেও হওয়া দরকার।

বিবিসি উত্তর আমেরিকার সংবাদদাতা জন সাডওয়ার্থ - গত এক দশক ধরে চীন থেকে প্রতিবেদন করেছেন – তিনি উল্লেখ করেছেন যে বুধবার এই বৈঠকের আগেই দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। যেমন গত সপ্তাহে, বহু বছর পর প্রথমবারের মতো, দুই পক্ষ তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগার নিয়ে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে দেখা করেছিল। বুধবার দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে তাইওয়ান নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। শি, আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে বলেছেন যে তিনি যেন "তাইওয়ানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করেন।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, ওই দ্বীপ দেশের সাথে চীনের পুনর্মিলন 'অনিবার্য' ছিল। সহজ করে বললে, চীনের সাথে তাইওয়ানের যুক্ত হওয়াটা এক রকম নিশ্চিত। এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হবে না।

৪. আলোচনা চলবে
দুই দেশের চুক্তির বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট থাকলেও, এটি নিছক একটি বৈঠক ছিল। এবং মি. বাইডেন এবং মি. শি করমর্দন করেছেন - একে একটি ইতিবাচক লক্ষণ বলে মনে করেন বিবিসির উত্তর আমেরিকা সম্পাদক সারাহ স্মিথ। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই প্রেসিডেন্টের একে অপরের সাথে কথা বলতে পারাই এক ধরণের কূটনৈতিক অর্জন। যদি তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে সম্মত হতে পারে, তবে এটি একাই একটি সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

বৈঠক শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাইডেন শিকে বলেছিলেন, আমি আমাদের কথার মূল্য দিই কারণ আমি মনে করি আমরা নেতা হিসেবে পরস্পরকে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, কোন ভুল ধারণা বা ভুল বোঝাবুঝি ছাড়াই। চীনা নেতা এতে সম্মত হন। তিনি বলেন, সংঘাত ও সংঘর্ষ উভয় পক্ষের জন্যই অসহনীয় পরিণতি বয়ে আনে। দুই দেশ এখনও অনেক বিষয়ে দুই মেরুতে রয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে অসম্মতি জানাতে সম্মত হওয়াও একটি শুরু। তবে কিছু পর্যবেক্ষক এ ব্যাপারে অত্যধিক আশাবাদী না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটির চীনা গবেষণার পরিচালক দিমিতার গুয়েরগুইভ বলেছেন, গত চার মাসে ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সত্যিই অসাধারণ উন্নতি হয়েছে, ওইসব বৈঠকের বেশিরভাগই এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা -অ্যাপেকের সাথে যুক্ত ছিল, তবে আমাদের এটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে, দুই দেশের সম্পর্কের ইতিবাচক ধারা চলমান থাকবে বা বজায় থাকবেই।