রহমত নিউজ 23 July, 2023 10:49 AM
বাংলাদেশে গত একমাসের বেশি সময় ধরে জন্ম নিবন্ধন সনদ করতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। বিশেষ করে সরকারি একটি ওয়েবসাইটের তথ্য উন্মুক্ত থাকার খবর প্রকাশের পর এই জটিলতা আরও বেড়েছে। যদিও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয় বলছে, সার্ভার নিয়ে কোন জটিলতা নেই, বরং স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছা করে অথবা অদক্ষতার কারণে সেবা দিতে পারছে না। অন্যদিকে রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে প্রায় একমাস ধরে। কিন্তু এর ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সোহানা ইয়াসমিনের মতো অনেক সাধারণ মানুষ। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয় পত্র, ভিসা আবেদনসহ ১৯টি নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
গত একমাস ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বাসিন্দা সোহানা ইয়াসমিন এক বছর বয়সী ছেলের জন্ম নিবন্ধন করানোর জন্য সিটি কর্পোরেশনে ঘুরছেন। কিন্তু সেখান থেকে তাকে বলা হয়েছে, মেয়রের নির্দেশে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। কবে চালু হবে, কারও জানা নেই। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের পাসপোর্ট করাতে চাইছি, সে জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ লাগবে। গত একমাস ধরে যোগাযোগ করছি, কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের লোকজন বলে, মেয়রের নির্দেশে নিবন্ধন কার্যক্রম আপাতত বন্ধ আছে। কবে চালু হবে, তা কেউ জানে না। এখন আমিও জানি না, আমার ছেলের পাসপোর্ট কবে করাতে পারবো। ওরটা করাতে পারছি না বলে আমরাও কেউ জরুরি দরকারেও ভিসার আবেদন করতে পারছি না। তার মতো ভোগান্তিতে পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের হাজার হাজার মানুষ।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার আইনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, এই দফতর থেকে যেসব সেবা দেয়া হবে, সেজন্য যে কর বা ফি নেয়া হবে, সেটা স্থানীয় সরকারের নিজস্ব আয় হওয়ার কথা। কিন্তু জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যয় এসব দপ্তর করলেও কোন আয় পায় না। ’একটা সার্টিফিকেট প্রিন্ট করতে গেলে আমাদের কমপক্ষে ৪০ টাকা লাগে। সেখানে জনবল, যন্ত্রপাতি-সেসব কিছুও আমাদের দিতে হয়। কিন্তু সেখানে যে ফি নেয়া হয়, সেটা পুরোপুরি সরকারি তহবিলে চলে যায়। এটা নিয়ে আমাদের মাননীয় মেয়র মহোদয় মন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। শীঘ্রই হয়তো সমাধান হয়ে যাবে।‘
গত সপ্তাহে এ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি আলোচনা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বিষয়ে আলোচনা হলেও এখনো চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে অবশ্য আগের মতোই জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও সার্ভার জটিলতায় ঠিক মতো সেবা পাচ্ছেন না নাগরিকরা। নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা একজন সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে কোন কাজ করা যায়নি। কারণ সার্ভারেই ঢোকা যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার বিকালের দিকে কিছু ফাইলের প্রিন্ট দেয়া গেছে। এর আগেও বেশিরভাগ সময় দিনের বেলায় সার্ভারে প্রবেশ করা যায় না। ফলে অনেককে নিবন্ধন সনদ দেয়ার তারিখ দেয়া হলেও নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করা যায় না।
বাংলাদেশে ২০০৪ সালে জন্ম নিবন্ধন আইন করা হলেও কার্যকর হয় ২০০৬ সাল থেকে। ২০১০ সালে সার্ভার পরিবর্তন করা হলে দেখা যায়, ২০১১ সালের আগে করা অনেক সনদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তাদের আবার নতুন করে জন্ম সনদ করাতে হয়। তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি হলেও জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ১৯ কোটি ৩৫ লাখের বেশি। ভালো স্কুলে ভর্তি বা বয়স কমাতে একাধিক জন্ম নিবন্ধন এজন্য দায়ী বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।
ঢাকার বাইরে আরো বেশি ভোগান্তি
জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করে এবং ফি প্রযোজ্য হলে সেটা জমা দেয়ার পর স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসে যেতে হয়। সেখানে আবেদন পত্র ও কাগজপত্রের একটি সেট জমা দেয়া দিতে হয়। তারা তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পরে সনদ ইস্যু করেন। ঢাকায় যেমন দুই সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে এই সনদ নিতে হয়। ঢাকার বাইরে পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে সনদ গ্রহণ করতে হয়।
ভোলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের সচিব মোঃ নোমান বলছেন, ’দিনের বেলায় তো আমরা অনলাইনে ঢুকতেই পারি না, খালি ঘোরে। গত দুই সপ্তাহ ধরে একটা জন্ম নিবন্ধনের সার্টিফিকেটও প্রিন্ট করাতে পারি না। মানুষজন এসে আমাদের গালাগালি করে, আসলে আমাদের তো কোন দোষ নাই। সার্ভারে যদি আমরা ঢুকতে না পারি, তাহলে কীভাবে কাজ করবো?’’
নারায়ণগঞ্জের এনায়েতপুর ইউনিয়নের সচিব মোঃ দিদার হোসেন বলছেন, রবিবার থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে শেষের দিন একটু সার্ভারে ঢুকতে পারছিলাম। তাতে কয়েকটা সার্টিফিকেট প্রিন্ট করাইছি। এখনো অনেক বাকি আছে। গত এক দেড় মাস ধরেই একই অবস্থা।‘
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইউনিয়ন পরিষদের আরও আটজন সচিবের সঙ্গে। তাদের সবার বক্তব্য অনেকটাই একই রকম।
কুড়িগ্রামের কাশীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম একমাস আগে সনদের জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। এখনো তিনি সনদ পাননি।
তবে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিভাগের রেজিস্টার জেনারেল মোঃ রাশেদুল হাসান দাবি করেছেন, তাদের সার্ভার ঠিক আছে, কিন্তু যাদের সনদ দেয়ার কথা, সেখানকার কর্মকর্তাদের অনীহা আর অদক্ষতার কারণে নাগরিকরা সেবা পাচ্ছে না। আমাদের কোন সমস্যা নেই, সার্ভারে কোন সমস্যা নেই। নিবন্ধন হচ্ছে না, কারণ তারা ঠিক মতো কাজ করছে না বা জানে না। কোন কোন সময় উন্নয়নের জন্য সার্ভার কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে, সেটা নোটিশ দেয়া হয়। ওরা কাজ করে না, পাবলিক গেলে বলে সার্ভার ডাউন আছে। এগুলো ঠিক না।‘
বর্তমানে সারা দেশে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা প্রশাসন সবমিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার আইডি থেকে এই সেবা নেয়া হয়ে থাকে। জুন মাসেই খবর প্রকাশিত হয় যে, বাংলাদেশের সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের মজুদ থাকা নাগরিকদের তথ্য উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেছেন, প্রাথমিকভাবে দুইটা ওয়েবসাইটকে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখান থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন এবং আমাদের ভূমি মন্ত্রণালয়ের সার্ভার।
যদিও সরকারি কোন দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়ে জানানো হয়। এই বিষয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষ জনবলের অভাব ও কারিগরি ক্রুটি কারণে সরকারি ওয়েবসাইটে জনগণের তথ্য উন্মুক্ত ছিল। ওই ঘটনার পর সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সার্ভারে কোনরকম পরিবর্তন আনা হয়েছে কিনা, জানতে চাওয়া হলে রেজিস্টার জেনারেল মোঃ রাশেদুল হাসান বলছেন, ‘আপগ্রেডেশনের কাজ হয়েছে, সেজন্য হয়তো কোনদিন এক ঘণ্টা হয়তো সার্ভার বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু কখনোই সার্ভার পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়নি। ইন্টারনেট ধীরগতির থাকতে পারে, অনেকে হয়তো ঠিক মতো কাজ করতে জানে না, একজনকে আইডি দেয়া আছে, কিন্তু পরিচালনা করে আরেকজন, উপরি আশা করে- এসবের জন্য তারা কমন একটা কথা বলে দেয়, সার্ভার ডাউন আছে। আসলে এই অভিযোগ ঠিক না।
বর্তমানে স্থানীয় সরকারের একেকটি প্রতিষ্ঠান একেক রকম সনদ ইস্যু করে থাকে। কিন্তু এই মাসের ২৫ তারিখ থেকে নতুন ধরনের নিবন্ধন সনদ দেয়া শুরু হবে। সেটা চালু হলে দেশের সব জায়গা থেকে জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে একই রকম সনদ পাওয়া যাবে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সাবির আহমেদ সুমন বলছেন, এখানে পরিকল্পনাগত একটা বিশাল ক্রুটি আছে। ব্যবহারকারীদের কতটা সহজে এবং আরামে সেবা দেয়া যাবে, সেটা বিবেচনায় রাখা হলে এসব সমস্যা হতো। যেমন একবার অনলাইনে কাগজপত্র দিয়ে নিবন্ধন করার পরে কেন আবার সেটার হার্ড কপি জমা দিতে হবে? আবার দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় জন্ম নিবন্ধনের নম্বর বার বার বদলানো হয়েছে। জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি, পাসপোর্ট- একেক ক্ষেত্রে একেক নাম্বার নিয়ে মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।এসব প্রকল্প যতটা সক্ষমতা নিয়ে তৈরি করা উচিত ছিল, সেভাবে আসলে করা হয়নি। ফলে এখন যেহেতু ব্যবহারকারী বেড়েছে, অনেকে একসঙ্গে প্রবেশের চেষ্টা করলেও সার্ভার ধীরগতির হয়ে যাচ্ছে। এখন তাদের উচিত প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এর দ্রুত সমাধান করা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা