| |
               

মূল পাতা ইসলাম হজ্বের ঐতিহাসিক পটভূমি


১৯৫৩ সালে তোলা হজ্বের ছবি

হজ্বের ঐতিহাসিক পটভূমি


মাওলানা মুহাম্মদ হারুন আযিযী নদভী       17 June, 2023     07:55 AM    


সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সকল বস্তু ও মানবকুল। আর অবতীর্ণ করেছেন তাদের হেদায়েতের জন্য তাঁর ঐশীবাণী আল্ কুরআনুল কারীম, যা হ’ল এক অপরিবর্তনীয়, চিরস্থায়ী ও সর্বশেষ আসমানী বিধান। অসংখ্য ছালাত ও সালাম নবীকুল শিরোমনি ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ মোস্তাফা ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তারঁ পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতিও। 

আল্লাহ্ তাআ’লা বলেছেনঃ  وأتموا الحج والعمرة لله
 ‘তেমারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হজ্ব ও উমরা আদায় কর’। (সুরা আল্ বাকারা ১০৬ ।) 
অন্যত্র তিনি বলেছেনঃ  ولله على الناس حج  البيت من استطا ع اليه سبيلا . ومن كفر قان الله غنى عن العالمين .  
“আর এই ঘরের হজ্ব করা হ’ল মানুষের উপর আল্লাহর প্যাপ্য। যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না, আল্লাহ সারা বিশ্বের কোন কিছুরই পরোয়া করেন না। (সুরা আল ইমরান ৯৭।) আবুহুরায়রা (রা) বলেনঃ রসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মাবরুর হজ্বের একমাত্র বদলা হল জান্নাত। (সহীহ আল বুখারী, ২/১৭৪ হাঃ ১৬৪৭।) 

সংজ্ঞা ও পরিচয়
‘হজ্ব’ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হল, ইচ্ছা করা ও সংকল্প করা। আর শরীয়তের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাদি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে কা’বা শরীফে গমন করা কে ‘হজ্ব’ বলা হয়।  

‘হজ্ব’ ইসলামের মৌলিক পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম স্তম্ভ। এটি আর্থিক ও শারিরীক ইবাদত। এতে রয়েছে মানুষের জন্য আত্মিক ও আধ্যাত্ত্বিক,  ব্যক্তিগত,  সামাজিক ও বিশ্বব্যাপী এবং ইহকালীন ও পরকালীন অনেক উপকার। এর দ্বারা পাপ মোচন হয়, দারিদ্র দূর হয়, আয়-রোজগারে বরকত হয় এবং মানুষ নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যায়।

‘উমরাহ’ আরবী শব্দ। তার আভিধানিক অর্থ হল, পরিদর্শণ বা সাক্ষাৎ। শরীয়তের পরিভাষায় উমরা হল, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নিদিষ্ট ক্রিয়া-পদ্ধতি সহকারে বায়তুল্লাহ শরীফকে পরিদর্শনের জন্য মক্কায় যাওয়া এবং তথায় বিশেষ আমল আদায় করা।  

মতান্তরে সামর্থবান ব্যক্তিদের জন্য উমরা পালন ওয়াজিব বা সুন্নাত। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ ‘তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হজ্ব ও উমরা আদায় কর’।    

যদিও ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্বের সাথে উমরার কথা উল্লেখ করা হয়, তথাপি উমরা একটি স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কখনো তাতে হজ্বের সমান পূণ্যও পাওয়া যায়। 

ঐতিহাসিক পটভূমি
কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন করলে বুঝা যায় যে, ইসলামের পূর্বেও হজ্বের বিধান ছিল এবং লোকেরা হজ্ব করত। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে ইবরাহীম (আঃ) এর মত প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতর প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এঘরের হজ্ব করা হল, মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক মানে না-আল্লাহ সারা বিশ্বের কোন কিছুরই পরোয়া করেন না’।  

এই আয়াতের তাফসীরে সালাফগণের দুটি ভিন্ন মত পাওয়া যায়। প্রথম, এটি ছিল সারা বিশ্বের সর্ব প্রথম ইবাদতগৃহ। দ্বিতীয়, এটি হল, সর্ব প্রথম গৃহ যা ইবাদতের জন্য নির্মিত হয়েছিল। ইতিপূর্বে কোন ইবাদতগৃহও ছিল না এবং কোন বাসগৃহও ছিল না। উভয় মতানুসারে আদম (আঃ) এর যুগ থেকেই যে গৃহটি বিদ্যমান ছিল তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। কারণ তিনিই ছিলেন সর্ব প্রথম মানুষ ও সর্ব প্রথম নবী। তাঁর পক্ষে এমনটি অকল্পনীয় নয় যে, পৃথিবীতে আগমনের পর তিনি নিজের জন্য বাসগৃহ নির্মানের আগেই আল্লাহর ইবাদতের গৃহ নির্মাণ করেন। আবুযর গেফারী (রাজিঃ) বলেনঃ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বললেনঃ মসজিদুল হারাম। আমি বললামঃ তারপর কোন টি? বললেন মসজিদুল আকসা। আমি বললামঃ উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কতটুকু ? বললেনঃ চল্লিশ বছর।  

তা হলে বুঝা গেল যে, বায়তুল্লাহর প্রথম নির্মাণ আদম (আঃ) কে পৃথিবীতে প্রেরণের পূর্বে বা সাথে সাথেই হয়েছিল। আদম (আঃ) ও তাঁর পরবর্তী পয়গাম্বরগণ বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ  করতেন। নূহ (আঃ) এর মহা প্লাবনের সময় এই গৃহ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। পরে ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর আদেশে প্রাচীন ভিত্তির উপর এ গৃহ পুনঃনির্মান করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ ‘যখন আমি ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক কর না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তওয়াফকারীদের জন্য, নামাযে দন্ডায়মানদের জন্য এবং রুকু-সেজদাকারীদের জন্য। এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্ব প্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দুর-দুরান্ত থেকে’।  

অন্যত্র তিনি বলেছেনঃ ‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দুআ করছিলঃ পরওয়ারদেগার! আমাদের থেকে কবুল কর। নিশ্চয়, তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ’।  

ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন আদনানী আরবদের পূর্ব পুরুষ। অন্ততঃ চার হাজার বছর পূর্বে তিনি ইরাকের ‘উর’ নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ‘আযর’ ছিল সমকালীন মূর্তি নির্মাতা ও ধর্মজাজক। তিনি দেখলেন যে, সমগ্র জাতি এমনকি তাঁর আপন পরিবারের সবাই মূর্তি পূজায় লিপ্ত। সবার বিশ্বাস ও রীতিনীতির বিপরীত একটি সনাতন ধর্ম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে দেয়া হল এবং জাতিকে এধর্মের দিকে আহবান জানানোর গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁদে অর্পন করা হল। তিনি পয়গম্বরসুলভ দৃঢ়তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে নির্ভয়ে জাতিকে এক আল্লাহর দিকে আহবান জানান। বিভিন্ন পন্থায় মূর্তিপুজার নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করেন। 

প্রকৃতপক্ষে কার্যক্ষেত্রে তিনি মূর্তিসমূহের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। ফলে সমগ্র জাতি তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়। বাদশাহ নমরূদ ও তার পরিষদবর্গ তাঁকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহর খলীল প্রভুর সন্তুষ্টির জন্যে এসব বিপদাপদ সত্ত্বেও হাসিমুখে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপের জন্যে পেশ করেন। অতঃপর আল্লাহর তা’আলা স্বীয় বন্ধুকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখে আগুনকে নির্দেশ প্রদান করলেনঃ ‘আমি হুকুম দিয়ে দিলাম হে অগ্নি, ইবরাহীমের উপর সুশীতল ও নিরাপত্তার কারণ হয়ে যাও’।  

অতঃপর তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় জন্মভূমি ও মাতৃভূমিকে হাসিমুখে ত্যাগ করে স্বপরিবারে সিরিয়ার ‘খরাঁন’ নামাক শহরে হিজরত করেন। তারপর ফিলিস্তিন গমন করেন। একদা সেখান থেকে মিসরে যান। তখন তাঁর সহধর্মীনি সারা (আঃ) এর খেদমতের জন্য মিসরের তৎকালীন সম্রাট স্বীয় কন্যা হাজেরা কে দান করেন। অতঃপর ফিলিস্তিন প্রত্যাবর্তন করে হাজেরা (আঃ) কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। আশি বছর বয়সে হাজেরা (আঃ) তাঁর একটি পুত্র সন্তান ইসমাঈল (আঃ) কে জম্ম দেন। এদিকে আল্লাহর আদেশ আসে যে, বিবি হাজেরা ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দিয়ে এখান থেকে স্থানান্তরে গমন করুন। নির্দেশ পেয়ে  তিনি জিবরীল (আঃ) এর সাথে স্বপরিবারে রওয়ানা দেন। চলতে চলতে যখন শুষ্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর এসে গেল (যেখানে ভবিষ্যৎে বায়তুল্লাহ নির্মাণ ও মক্কা নগরী আবাদ করা লক্ষ্য ছিল) তখন সেখানেই তাদের থামিয়ে দেয়া হল। আল্লাহর খলীল এই জনশূণ্য ও তৃণলতাহীন মরুভূমিতে স্বীয় স্ত্রী ও কলিজার টুকরা ছেলে ইসমাঈল (আঃ) কে ছেড়ে আল্লাহর আদেশে পুনরায় ফিলিস্তিনের দিকে রওয়ানা দিলেন। হাজেরা (আঃ) তাঁকে চলে যেতে দেখে কয়েকবার ডেকে অবশেষে কাতরকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এজন-মাহবহীন প্রান্তরে আমাদের একা ফেলে রেখে কোথায় যাচ্ছেন? কিন্তু ইবরাহীম (আঃ) নির্বিকার কোন উত্তর নেই। অবশ্য হাজেরাও ছিলেন খলিলুল্লাহরই সহধর্মিনী। ব্যাপার বুঝে ফেললেন। ডেকে বললেন, আপনি কি আল্লাহর কোন নির্দেশ পেয়েছেন? ইবরাহীম (আঃ) বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর নির্দেশের কথা জানতে পেরে হাজেরা (আঃ) খুশী মনে বললেনঃ যান। যে প্রভু আপনাকে চলে যেতে বলেছেন, তিনি আমাদের ধ্বংস হতে দেবেন না। ইবরাহীম (আঃ) এর এভাবে স্বজাতি ও জম্মভূমি ত্যাগ করে স্বজন হারা হয়ে এস্থানে পৌঁছাকে আল্লাহ তা’আলা এতই পছন্দ করলেন যে, কিয়ামত পর্যন্ত যাদের উপর হজ্ব ফরয হবে তাদের সবার জন্য এটি বিধিবদ্ধ করে দিলেন যে, তাদের সবাইকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্দব, ঘর-বাড়ী এবং দেশ সব কিছু ত্যাগ করে এমনকি পরিধানের কাপড় পর্যন্ত ত্যাগ করে ইহরাম বেঁধে এই ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। 

হাজেরা (আঃ) তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে এই জন-মানবহীন প্রান্তরে কালাতিপাত করতে লাগলেন। ইবরাহীম (আঃ) চলে যাবার সময় তাঁদেরকে এক জগ পানি ও কিছু খেজুর দিয়ে যান। যা অল্প দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তখন এক সময় দারুণ পিপাষা তাঁকে পানির খোঁজে বের হতে বাধ্য করল। তিনি শিশুকে উম্মুক্ত প্রান্তরে রেখে ‘ছাপা’ ‘মারওয়া’ পাহাড়ে বার বার ওঠানামা করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও পানির চিহ্নমাত্র দেখলেন না এবং এমন কোন মানুষ দৃষ্টিগোচর হল না, যার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে পারেন। সাত বার ছোটাছুটি করার পর তিনি নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন। এঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যেই ‘ছাফা’ ও ‘মারওয়া’ পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে সাত বার দৌড়া কিয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে হজ্বের বিধি-বিধানে অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। হাজেরা (আঃ) যখন দৌড়াদৌড়ি শেষ করে নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন, তখন আল্লাহর রহমত নাযিল হল। সাত বার ছোটাছুটি করে এখনও তিনি মারওয়াতেই ছিলেন, হঠাৎ একটি স্বর শুনতে পেয়ে ফিরে দেখলেন যে, জিবরীল (আঃ) পায়ের মুড়ি মেরে ‘যমযম’ কুপ খনন করলেন এবং আল্লাহর আদেশে শুস্ক মরুভুমিতে পানির একটি ঝর্ণাধারা বইয়ে দিলেন। হাজেরা (আঃ) কুপটির চতুর্পাশ্বে বাঁধ দিয়ে দিলেন। পানির সন্ধান পেয়ে প্রথমে জীব-জন্তু আগমন করল। জীব-জন্তু দেখে মানুষ এসে সেখানে আস্তানা গাড়ল। এভাবে মক্কায় জনপদের ভিত্তি রচিত হয়ে গেল। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্রও সংগৃহীত হল। 

এই মহা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আল্লাহ তা’আলা ইবরাহীম (আঃ) কে পুরুস্কার দান করলেন। তাতে ছিল আল্লাহর ঘর নির্মাণের মহান মর্যাদা। আল্লাহর আদেশে পিতা-পূত্র উভয় মিলে বায়তুল্লাহ নির্মাণ শুরু করলেন। যখন হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত পৌঁছলেন ইবরাহীম (আঃ) ইসমাঈলকে বললেনঃ যাও একটি সুন্দর পাথর নিয়ে এসো। যখন তিনি পাথর নিয়ে আসলেন তখন দেখলেন যে, ইবরাহীম (আঃ) সেস্থানে আর একটি পাথর লেগে দিয়েছেন। তখন জিজ্ঞেস করলেন, এই পাথর কোথা থেকে আসল? ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ আল্লাহর আদেশে জিবরীল (আঃ) পাথর নিয়ে এসেছেন। (ইবনু কাছীর) এই পাথরটি হল হাজরে আছওয়াদ তথা কালো পাথর। যাকে তাওয়াফের সময় প্রতি চক্করে সম্ভব হলে চুমু খাওয়া, ষ্পর্শ করা কিংবা তার দিকে ইঙ্গিত করার বিধান রয়েছে। রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হাজরে আছওয়াদ একটি জান্নাতি পাথর। তা ছিল দুধের মত সাদা। কিন্তু মানুষের পাপাচার তাকে কালো করে ফেলেছে। (তিরমিযী, ইবনু খুযায়মা।) যখন দেয়াল উঁচু হয়ে গেল তখন ইসমাঈল (আঃ) একটি পাথর খুঁজে নিয়ে আসলেন, তার উপর দাঁড়িয়ে ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করলেন। এটি হল, সেই পাথর যাকে ‘মাকামে ইবরাহীম’ বলা হয়। রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষ্য অনুযায়ী এটিও ছিল একটি জান্নাতি পাথর। অনুরূপভাবে ‘রুকনে ইয়ামানী’ও একটি জান্নাতি পাথর। 

মোট কথা, আল্লাহর ঘরে তিনটি জান্নাতি পাথর রয়েছে, (১) হাজরে আছওয়াদ, (২) মাকামে ইবরাহীম, (৩) এবং রুকনে ইয়ামানীর পাথরটি। 

যখন ঘর নির্মাণ পরিপূর্ণ হল, তখন আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ) কে আদেশ দিলেন-মানুষের মধ্যে হজ্বের ঘোষণা করে দাও।   কিয়ামত পর্যন্ত যত লোকেরা হজ্ব করবে, তারা সবাই ইবরাহীমি ঘোষণার উত্তর হিসেবে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ বলতে বলতে কা’বা শরীফে পৌঁছতে থাকবে। 

যত দিন ইসমাঈল (আঃ) জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনিই ‘বায়তুল্লাহ’ শরীফের মুতাওয়াল্লী তথা তত্বাবধায়ক ছিলেন। তাঁর ইন্তিকালের পর ‘জুরহুম’ গোত্রের সরদার বায়তল্লাহর মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত হল। এক দুর্ঘটনায় প্রাচীর ধ্বসে যাবার কারণে তারা কা’বা শরীফকে পুনঃনির্মাণ  করল। তাদের পর ‘আমালেকাহ’ সম্প্রদায় আর একবার কা’বা শরীফ নির্মাণ করেছিল। জুরহুমদের সময়কালে দ্বীনে ইবরাহীমিতে পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছিল। ফলে ‘খুযাআহ’ গোত্রের লোকেরা যুদ্ধ করে জুরহুমদের থেকে বায়তুল্লাহ শরীফের তত্বাবধানের দায়িত্বভার চিনিয়ে নিল। তাদের সময়ে দ্বীনে ইবরাহীমিতে পরিবর্তন আরো বৃদ্ধি পেল। এমনকি বায়তুল্লাহ শরীফ শিরকের মান্ডবে পরিণত হল। লাত, মানাত, উযযা, ও হুবুল নামের মূর্তির সাথে সাথে ইবরাহীম (আঃ) এর নামে মূর্তি গড়ে বায়তুল্লাহ শরীফে রেখে দেয়া হয়েছিল। ‘খুযাআ’ গোত্রের পর বায়তুল্লাহ শরীফের মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত হলেন ‘কুরাইশগণ’। এরা ছিলেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর। এদের প্রথম সরদার ছিল ‘কুছাই’। আর পরবর্তিদের মধ্যে ছিল, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও চাচা আবুতালিব। কুরাইশদের সময়কালে ঘরটির ব্যাপক ক্ষতি হবার কারণে তারা পুনঃনির্মাণ করেন। তখনকার নির্মাণে রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও  শরীক ছিলেন এবং নিজ হাতে হাজরে আছওয়াদকে তার স্থানে স্থাপন করে দিলেন। 

রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নুবুওয়াতের ২১ বছর পরও বায়তুল্লাহ শরীফ মূর্তিসমূহের আস্তানা ও কেন্দ্র ছিল। আর পৌত্তলিকরা নিয়ম মতে হজ্ব করে আসছিল। ইবরাহীম (আঃ) কাবা শরীফ নির্মাণের সময় দুআ করেছিলেন “হে আল্লাহ তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী হেকমত ওয়ালা।     

ইবরাহীম (আঃ) এর এই দুআ শেষ নবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হল। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি ইবরাহীমের দুআ’।     

অতএব তাঁর হাতে ৮ম হিজরী সনে মক্কা বিজয় ঘটে। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি ‘বায়তুল্লাহ শরীফ' কে সব রকমের মূর্তি ও ভাষ্কর্য থেকে পবিত্র ও শিরক থেকে মুক্ত করেন। ৯ম হিজরী সনে হজ্ব ফরয হলে রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবুবকর (রাজিঃ) কে হাজীদের আমীর নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন এবং ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান মতে হজ্ব সম্পাদন করেন। ১০ম হিজরী সনে তিনি এক লক্ষ চব্বিশ হাজার কিংবা চল্লিশ হাজার সাহাবীদেরকে নিয়ে জীবনের প্রথম ও শেষ হজ্ব ‘হাজ্জাতুল ওদা’ তথা বিদায় হজ্ব আদায় করেন। এর পর থেকে প্রতি বছর ইসলামী নিয়ম-নীতি মোতাবেক হজ্ব আদায় করা হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে ইনশা আল্লাহ। রাসূল কারীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর শপথ! ইয়াজুজ-মাজুজ বের হবার পরও বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্ব ও উমরা পালন করা চালু থাকবে।