হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর 04 February, 2023 04:53 PM
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় যে শিশুর পিতা ইন্তেকাল করে তাকে এতিম বলা হয়। পিতৃহারা হওয়ার কারণে এতিমেরা শৈশব থেকেই অকৃত্রিম পিতৃস্নেহ ও মায়া-মমতার পরশ থেকে বঞ্চিত হয়। তাই তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা, তাদের যথাযথ হক করা ইসলামের সুমহান নির্দেশ। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, "আর তোমরা ইবাদত কর একমাত্র আল্লাহর, তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির ও নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-অহঙ্কারীকে।"- (সূরা-নিসা, আয়াত-৩৬)।
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নিজ ইবাদতের নির্দেশ প্রদানের পরপরই পিতা-মাতাসহ যাদের সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন তাদের মধ্যে এতিমেরা অন্যতম। মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামে এতিমের প্রতি সহানুভূতিপরায়ণতা ও যত্নশীলতাকে কিরূপ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আলোচ্য আয়াতটি তার প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ। আয়াতটির শেষাংশে ইরশাদ হয়েছে, "নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।" আয়াতের এ অংশটি পূর্ববর্তী বক্তব্যের উপসংহার। কারণ উক্ত আয়াতে যাদের হক সম্পর্কে তাগিদারোপ করা হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে ওইসব লোকই শৈথিল্য বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করে যাদের মন-মানসিকতায় আত্মগরিমা, অহমিকা ও দাম্ভিকতা বিদ্যমান। এতেই প্রতীয়মাণ হয় যে, এতিমদের অবজ্ঞা, অবহেলা, অনাদর করা চরম দাম্ভিকতা ও অহংবোধের বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং এতিমের প্রতি অসদাচরণকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। আর আল্লাহ যাকে অপছন্দ করেন তার ভয়াবহ পরিণাম অবধারিত।
এতিমের প্রতি অসদাচরণকারীকে আল্লাহ তা'আলা কিয়ামত দিবসের অস্বীকারকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, "আপনি কি দেখেছেন তাকে যে কিয়ামত দিবসকে মিথ্যা বলে ? সে সেই ব্যক্তি যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয়।"- (সূরা- মাউন, আয়াত-১ ও ২)। আল্লাহ তা'আলা আরও ইরশাদ করেন, "(হে নবী)! তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে এতিম সংক্রান্ত হুকুম। বলুন, তাদের সাথে সদাচরণ করাই উত্তম। আর যদি ব্যয়ভার নিজের সাথে মিশিয়ে নাও তাহলে মনে করো তারা তোমাদের ভাই।"- (সূরা- বাকারা, আয়াত- ২২০।) এ আয়াতে এতিমের সাথে সদাচরণের সাথে সাথে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতিমদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে তাদের সহায়-সম্পদের ওপর স্বার্থপরদের যে ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয় সে বিষয়ে কুরআন মজীদে আল্লাহ তা'আলা কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, এতিমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। ভালো মালামালের সাথে খারাপ মালামালের অদলবদল করো না। আর তাদের সম্পদের সাথে নিজেদের ধন-সম্পদ সংমিশ্রিত করে তা গ্রাস করো না। নিশ্চয় এটা বড়ই মন্দ কাজ।- (সূরা- নিসা, আয়াত-০২)। একই সূরার ১০ নং আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, "যারা এতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্ত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।" এ আয়াতের তাফসীরে এসেছে, কিয়ামত দিবসে যখন এতিমের সম্পদ ভক্ষণকারীকে পূনরুত্থান করা হবে তখন চোখ, নাক, কান ও মুখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হতে থাকবে। যে-ই তাকে দেখবে, চিনে ফেলবে সে এতিমের সম্পদ লু্ন্ঠনকারী।
এভাবেএতিমের সাথে অসদাচরণের ভয়াবহ পরিণাম ও সদাচরণের উত্তম প্রতিদান সম্পর্কে কুরআনুল কারীম ও হাদীস শরীফে ব্যাপক বর্ণনা বিদ্যমান। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, "আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব (এসময় তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুই আঙ্গুলের মধ্যে সামান্য ফাঁক রাখেন।)।" -(বুখারি শরীফ)।
এতিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং তাদের যথার্থ হক আদায়ে যত্নবান থাকার ব্যাপারে ইসলামের এ সুমহান নির্দেশ ও নবী করীম স. এর শাশ্বত শিক্ষা বাস্তবায়িত হলে সমাজে কোন এতিম আজ নিগৃহীত, বঞ্চিত, মজলুম থাকতো না। আজ পার্থিব ধনবানেরা প্রাচুর্যের পাহাড় গড়লেও পথে-প্রান্তরে, মাঠেঘাটে, খোলা আকাশের নিচে, জীর্ণশীর্ণ ছোট্ট কুটিরে অনেক এতিমেরা অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। একদিকে ধনীদের খাবারের বাহারী আয়োজন, অপরদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ফুটফাতের ডাস্টবিন থেকে অনেক এতিম-অসহায়দের খাবার কুড়িয়ে খাওয়ার করুণ দৃশ্য যেন মানবিক হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। আজ কত এতিম অযত্ন- অবহেলায় মানবিক স্নেহবাৎসল্য ও সঠিক দিশা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে বিপথগামী হয়ে অন্ধকার পথে পা বাড়াচ্ছে।
আমরা কি পারি না এতিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে? এতিমদের মাথার ওপর হাত বুলিয়ে কোমল হৃদয়ে তাদেরকে আগলে নেয়া কি মানবিক সমাজের কর্তব্য নয় ? পিতৃস্নেহের পরশবঞ্চিত মজলুম এতিমদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য নয় কি? আমরা কি পারি না ক্ষুধার্ত, বঞ্চিত এতিমদের মুখে হাসি ফুটাতে? আসুন! ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে ধারণ করে এতিমদের প্রতি মায়া-মমতার হাত প্রসারিত করি। তাদের প্রতি বিস্তৃত করি মানবিক অভিভাবকত্বের কোমল ছায়া। সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করি তাদের। পরম যত্নে প্রতিজন এতিমকে গড়ে তুলি একেকটি অমূল্য রত্নে।
লেখক : খতীব, শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ, কক্সবাজার।