| |
               

মূল পাতা ইসলাম যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকে করণীয়  


যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকে করণীয়  


মাওলানা মুহাম্মদ হারুন আযিযী নদভী       29 June, 2022     09:30 PM    


যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের দিনগুলোতে আমাদের করণীয় আছে অনেক বিষয়ঃ যথা; গুনাহ থেকে তাওবা করা, নফল নামায বেশী পড়া, ছদকা করা, রোযা রাখা, কুরআন তেলাওয়াত করা, যিকির করা, উমরা ও হজ্জ করা ইত্যাদি। নিম্নে কয়েকটি কাজের কথা উল্লেখ করা হলঃ

১- নখ, চুল ও লোম কাটা থেকে বিরত থাকা। 
যারা কুরবানী করবে তারা যেন নখ, চুল ও লোম কাটা থেকে বিরত থাকে। হযরত উম্মে সালমা (রাজিঃ) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন তোমরা যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা রাখবে সে যেন কুরবানীর পশু জবেহ করার আগ পর্যন্ত নিজের চুল, নখ, লোম ইত্যাদি না কাটে। (মুসলিম, ৫০৯১)  

২- রোযা রাখা, বিশেষ করে আরাফার দিন রোযা রাখাঃ  
এই দশ দিনে যে যত পারে বেশী বেশী রোযা রাখবে। বিশেষ করে যারা হজ্জে যায়নি তারা আরাফার দিন রোযা রাখবে। আবুকাতাদা (রাজিঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আরাফার দিনের রোযা আগের পরের দু’বছরের পাপ ক্ষমা করে দিবে। (মুসলিম, হাঃ/২৬১৪।) তবে আরাফার দিন রোযা রাখার বিধানটি হল, যারা হজ্জ করতে আসেন নি তাদের জন্য। সুতরাং আরাফায় অবস্থানকৃত হাজীরা এই রোযা পালন করবেন না।  

৩ - তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ও যিকির করা 
এই দিনগুলোতে বেশী বেশী যিকিরের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। বিশেষ করে ৯ তারিখ ফজরের নামাযের পর থেকে ১৩ তারিখ আছরের নামায পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাযের পর নারী-পুরুষ সকলের জন্য তাকবীরে তাশরীক বলা জরুরী। তাকবীরে তাশরীকের শব্দাবলী- ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। [ইবনু আবিশায়বাঃ ২/২/২, ইরওয়াউল গালীলঃ ৩/১২৫] 

৪ - বেশী বেশী তাসবীহ তাহলীল করা 
এই দিনগুলোতে বেশী বেশী তাসবীহ, তাহলীল ও তাহমীদেও বলবেন। হযরত ইবন উমর (রাজিঃ) বলেনঃ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "অন্যান্য সময়ে কৃত যে কোন নেক কাজের চেয়ে এ দশ দিনে অনুষ্ঠিত নেক কাজ আল্লাহর কাছে অনেক বেশী মর্যাদাসম্পন্ন এবং বেশী প্রিয়। সুতরাং তোমরা এ দিনগুলোতে বেশী করে তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ) পাঠ কর"। [আহমাদঃ ২/৭৫, ১৩১]।

৫ - হজ্জ ও উমরা আদায় করা 
যাদের উপর হজ্জ ফরজ তাদেরকে এই দিনগুলোতেই হজ্জ ও উমরা আদায় করতে হয়। হজ্জ ও উমরা আদায় করলে সারা জীবনের পাপ ক্ষমা হয়ে যায়। 
হযরত আবুহুরায়রা (রাজিঃ) বলেনঃ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে এবং তাতে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি। সে হজ্জ থেকে নবজাত শিশুর ন্যায় নিস্পাপ হয়ে ফিরবে। [সহীহ বুখারী, হাঃ ১৪২২] 
হযরত আমর ইবনুল আছ (রাজিঃ) বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললামঃ আপনার হাত প্রসস্ত করুন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত হতে চাই। তিনি হাত প্রসস্ত করলেন। কিন্তু আমি হাত গুঁটে নিলাম। তখন তিনি বললেনঃ হে আমর! কি হল? আমি বললামঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কিছু শর্ত দিতে চাই। বললেনঃ কি শর্ত? আমি বললামঃ পূর্বের পাপসমুহ মুছে যাবার শর্ত। তখন তিনি বললেনঃ তুমি কি জান না, ইসলামে প্রবেশ করলে পূর্বের সমূহ পাপ ক্ষমা হয়ে যায়। হিজরত করলে পূর্বের সমূহ পাপ ক্ষমা হয়ে যায়। আর হজ্জ করলে পূর্বের সমূহ পাপ ক্ষমা হয়ে যায়। [মুসলিম, হাঃ ১২১] 

৬ - ঈদের নামায আদায় করাঃ 
ঈদের দিনে ভোরে ঈদগাহে গিয়ে বা মসজিদে গিয়ে মুসলমানদের সহিত ঈদের নামায আদায় করবে। এটি এই দিনের বড় ইবাদত। তারপর খুতবা শুনবে। 

৭ - কুরবানী করা
এই দিনগুলোতে আরেকটি বড় ইবাদত হল, কুরবানী করা। এটি যিলহজ্জ মাসের ১০ম দিন থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত যে কোন একদিন করা যেতে পারে। তবে প্রথম দিন করাই উত্তম। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেনঃ “অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন”। (সুরা কাউসারঃ ২) 
অন্যত্র বলেনঃ “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও”। (সুরা হজ্জ, ৩৪) 

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাজিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি সাদা-কালো বর্ণের (বড় শিং বিশিষ্ট) নর দুম্বা কুরবানী করেছেন। আমি দেখেছি, তিনি দুম্বা দু’টির গর্দানে পা রেখে বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার বললেন। অতঃপর নিজ হাতে যবেহ করলেন। (বুখারীঃ ৫৫৫৮, মুসলিমঃ ১৯৬৬।) 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাজিঃ) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় দশ বছর পর্যন্ত কুরবানী করেছেন। (তিরমিযীঃ ৯৬) 
বিদাই হজ্জে তিনি ১০০ টি উট কুরবানী করেছেন। হযরত জাবির (রাজিঃ) বলেনঃ ‘অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি উট নহর করলেন। (মুসলিমঃ ১/৩৯৪।) 

৮ – সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই কুরবানী করতে হবে 
আবু হুরায়রা (রাজিঃ) বলেনঃ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্বেও কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে উপস্থিত না হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, নিকটবর্তী না হয়। (আহমদঃ ২/৩২১, সহীহ তারগীবঃ ১০৮৭।) 

এই হাদীস থেকে বুঝা যায়, সামর্থ্য থাকলে কুরবানী করা ওয়াজিব। এছাড়া সুরা কাউসারের আয়াত এবং মিখনাফ ইবনু সুলাইমের হাদীসটিও এর দলীল। এসকল দলীলের ভিত্তিতে মহিমান্বিত ইমামদের মধ্যে ইমাম আবুহানীফা (রহঃ) ও ইমাম মালেক (রহঃ) এবং এক বর্ণনা মতে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহঃ) সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব বলেছেন।   

৯ -যাদের কুরবানী করার সামর্থ নেই তারা কি করবে? 
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছে: ‘আমাকে কুরবানীর দিবসে ঈদ (উদযাপনের) আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তা এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন।’ এক ব্যক্তি আরজ করলেন,‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি ‘মানীহা’ থাকে (অর্থাৎ যা আমাকে শুধু দুধ পানের জন্য দেওয়া হয়েছে) আমি কি তা কুরবানী করতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না। তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। (সুনানে আবু দাউদ ২/৩৮৫; সুনানে নাসায়ী ২/১৭৯ ‘মানীহা’ হচ্ছে, যে পশু কাউকে দুধ পান করার জন্য বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়।) 

১০ -আইয়ামে তাশরীকে বেশী বেশী যিকির করা 
আইয়ামে তাশরীকে বেশী বেশী যিকির করবে। উকবা ইবনু আমের (রাজিঃ) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আরাফার দিন, কুরবানীর দিন এবং তাশরীকের দিনসমূহ মুসলিমদের জন্য ঈদের দিন। (আবুদাউদঃ ২৪১৯) 

নুবাইশা হুযালী (রাজিঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আইয়ামে তাশরীক (যিলহজ্জের ১১, ১২, ১৩) হল, পানাহার ও আল্লাহর যিকিরের দিন।  (মুসলিমঃ ১১৪১) 
মোট কথা, হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, নেক আমল করার মৌসুম হিসেবে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক হল সকল দিবসসমূহের চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। আর যা আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় তা তাঁর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। কোন কোন হাদীসে আহাব্বু (প্রিয়) শব্দটি এসেছে আবার কোন কোন বর্ণনায় আফজালু (মর্যাদাসম্পন্ন) শব্দ এসেছে।’ অতএব এ সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোন সময়ে নেক আমল করার চেয়ে বেশী মর্যাদা ও ফজীলতের অধিকারী হবে। 

অতএব আসুন আমরা এই দিনগুলোকে আল্লাহর ইবাদত ও যিকির আযকার এবং দুআ ও তাসবীহ তাহলীলের মধ্যে কাটাই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সদা ভাল কাজের তৌফীক দান করুন। আমীন।