ড. নাজনীন আহমেদ 09 June, 2022 11:50 AM
আজ ঘোষিত হবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। বিশেষ ব্যস্ততার কারণে অন্যান্য বছরের মতো জাতীয় বাজেটের নানা আলোচনায় সম্পৃক্ত থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। কিন্তু কয়েকটি বিষয় আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড দের সাথে শেয়ার না করে পারছি না। এ বছরের বাজেট নানা কারণে অন্য বছরের তুলনায় বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কোভিডের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির নানা সূচক গত দুই বছর টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়ায় সারা দুনিয়া জুড়ে মূল্যস্ফীতির গতি ছিল উপরের দিকে। এর উপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিভিন্ন পণ্যের স্বাভাবিক যোগান বিঘ্নিত করা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে শক্তি যুগিয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিও দীর্ঘদিনের পাঁচ শতাংশের আশে পাশে থাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে ছয় শতাংশের মাত্রা অতিক্রম করেছে বেশ কিছুদিন আগেই ।
তাই এই বাজেটের একদিকের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবেলা করা। আবার অন্যদিকে কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার বাস্তবতায় সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা চাপ -এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসা এবং সেইসাথে টাকার অবমূল্যায়ন -এই দুই এ মিলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন একটা বিশেষ চ্যালেঞ্জ। টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু তা রপ্তানি আয়, রেমিটেন্সের আয় এবং ক্যাপিটাল একাউন্টে নানারকম বিনিয়োগ সংক্রান্ত আয় দিয়েও পোষানো যাচ্ছে না। ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়ায় রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কে বাজার মূল্য উঠানামা করার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এই নীতির ফলে টাকার মূল্য আরো কমে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির প্রভাব দেশীয় মূল্যস্ফীতিকে আরো বাড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা আছে।
একদিকে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি - এই দুই ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটেই প্রণীত হচ্ছে এ বছরের বাজেট। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে কিছু বিষয়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ থাকতেই হবে।
১. যেহেতু বর্তমান মূল্যস্ফীতির একটি অংশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আসছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো হাত নেই, তাই বাজেটে দেশীয় বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মোকাবেলায় সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে বিভিন্ন রকম ফিসক্যাল উদ্যোগ বা ভর্তুকি ও কর সম্পর্কিত উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে যথাসম্ভব দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির লাগাম ধরে থাকা এবং সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ যোগানের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে সার ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এই দুই ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে যা একটি সঠিক পদক্ষেপ। সারের দাম ভর্তুকি না দিলে দেশীয় বাজারে সারের দাম বেড়ে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং তাতে খাদ্য মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। এভাবে জ্বালানি তেলের ভর্তুকিও কৃষিতে সেচ দেয়ার খরচ এবং গণপরিবহনের খরচ না বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। জ্বালানি তেলের ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে অকটেনে কোন ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ অকটেন সাধারণত সচ্ছল মানুষের যানবাহন ও অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। বরং সেই অর্থ দিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন।
২. সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরাসরি অর্থ প্রদান কর্মসূচী নগর দরিদ্রদের জন্য থাকতে হবে কারণ প্রায়ই দেখা যায় যে এ ধরনের কর্মসূচি গুলো মূলত গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য বেশি থাকে। কিন্তু নগর দরিদ্রদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দরকার। তাছাড়া খেয়াল রাখতে হবে ভর্তুকির জন্য অনেক অর্থ বরাদ্দ দিতে গিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দে যেন টান না পড়ে।
৩. কর্মসৃজনমূলক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। মানুষের যদি কাজ থাকে এবং তা থেকে আয় হয় তাহলে তার পক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকলেও জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা সম্ভব হয়।
৪. প্রকল্পসহ নানা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে।
৫. চ্যালেঞ্জপূর্ণ বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কর আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। হঠাৎ করে সংস্কার সম্ভব নয়। যে সংস্কার বিগত অনেক বছরে হয়নি এই এক বছরে তা করা যাবে না। কিন্তু এই সময়ে জনগণকে কর দিতে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। বিভিন্ন শহরে কর মেলার আয়োজন করে, কর আদায় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। প্রেক্ষিতে একটি তথ্য লক্ষণীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ এর জুন মাস থেকে শুরু করে ২০২১ এর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ কোভিডের চরম আক্রমণের দেড় বছর সময়ে অন্তত ১ কোটি টাকা ব্যাংকে আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে ১৫ হাজার ৯৩৯ জন এবং ব্যাংকে থাকা তাদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১,১২,৬৬৮ কোটি টাকা (বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত Scheduled Bank Statistics এর বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে calculate করেছি)। তার মানে বিপুল ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ও সক্ষমতা অনেক বেড়েছে । সেই সাথে কর দিতে সক্ষম এমন ব্যক্তির সংখ্যা এই সময়ে নিশ্চয় বেড়েছে। আমাদের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিও সে ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সেই অনুযায়ী কর আদায় কি আমরা বাড়াতে পেরেছি?
৬. নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ই-কমার্সসহ আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রশিক্ষণ সুবিধা দিতে বরাদ্দ থাকতে হবে, যাতে বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য আরো বাড়াতে পারেন।
সবশেষে বলতে চাই বাজেট প্রণয়নে মূল্যস্ফীতির প্রতিই বেশী মনোযোগ দেয়া দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া নিয়ে এত চিন্তিত হবার এখনই সময় আসেনি ।বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকেই সংকট মোকাবেলা করার জন্য। প্রয়োজনে আরো কিছু ডলার বাজারে আসলে সমস্যা এখনই নেই। বরং তাতে টাকার অবমূল্যায়নের গতি কিছুটা কমিয়ে রেখে মূল্যস্ফীতির জোয়ারে বাধা দেয়া সম্ভব হবে । আমরা আশাবাদী হতে পারি যে, মূল্যস্ফীতির যে অংশ কোভিড পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার জন্য মানুষের অতি চাহিদা থেকে আসছে, সেটার মাত্রা কয়েক মাসের মধ্যেই কমে যাবে। এখন ভাবতে হবে সাধারণ মানুষকে নিয়ে। উন্নয়নের সুফল ভোগকারী ধনী ব্যক্তিরও এগিয়ে আসতে হবে, দাঁড়াতে হবে মানুষের পাশে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ