মাওলানা রাদ তানবীর 12 May, 2022 01:42 PM
জরূরতে দীন তথা শরীয়তের যতটুকু জ্ঞান না হলেই নয় তা জানা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ। সাধারণত আমাদের এই দেশের মকতবগুলিতে এতটুকু জ্ঞানের শিক্ষা দেওয়া হত একসময়। এখনও দেওয়া হয় অনেক স্থানে। শিক্ষা দেওয়া হয় কুরআনুল কারীমের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত। ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে এই মকতবগুলির অবদান অনন্য। প্রভাতের স্নিগ্ধ হাওয়া আর সূর্যের নবীন আলোর সাথে ভেসে বেড়ানো শিশুদের কোমল কণ্ঠ আলিফ্, বা, তা, ছা হৃদয়ে জাগিয়ে দেয় প্রফুল্লতার বারিধারা। মকতবশিক্ষার দ্বারা কচি ও পাপহীন শিশুমনে সৃষ্টি হয় আল্লাহর সাথে এক পবিত্র বন্ধন। তাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় জন্ম নেয় ধর্মপ্রীতি ও নবীপ্রেম। এসব শিশুরা বড় হয়ে স্কুলে যায়, কলেজে যায়, এরপরও তাদের মধ্যে থাকে নিগূঢ় ধর্মপ্রীতি, দৃঢ় প্রভুভক্তি। ইসলামের প্রতিটি শাখার উপর থাকে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আমাদের অধিকাংশের বাবা-মা, দাদা-দাদী মকতব থেকেই ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেছিলেন৷ প্রয়োজন পরিমাণ দীনি জ্ঞান ও মাসায়েল তারা হৃদয়ে সংরক্ষণ করেছেন এই মকতব থেকেই। মকতবগুলি তখন ভরে যেত অগণিত পুষ্পে, পুষ্পের মুকুলে। সুগন্ধ ছড়াতো সেইসব পুষ্প ও মুকুল! প্রজাপতিরাও হয়ত আসতো নিদ্রা ত্যাগ করে কচি পুষ্পের পাপড়ি দখল করতে! তাদের সুরভিতে বিমোহিত হতো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র! ভোরের শিশিররা স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিত শিশুদের পায়ের পাতায়। বাহবা দিত প্রভাতরবি পূর্বদিগন্তে আলো ছড়িয়ে শিশুদের মসজিদমুখে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে!
কিন্তু এখনকার মকতবগুলিতে আগের মতো ভিড় নেই। কালের আবর্তনে বিভিন্ন প্রতিকূলতার শিকার আজকের মকতবগুলি। শিশুরা আর মকতবে ছুটে না শান্তির ঘুম ছেড়ে আগের ন্যায়। কতক শিক্ষাঙ্গন কেড়ে নিয়েছে তাদের মগজগুলো, তাদের অভিভাবকদের মস্তিষ্কগুলো। প্রভাতকালে তাদের শিক্ষা শুরু হয় আজ এ,বি,সি... দিয়ে। শিশুমস্তিষ্কগুলোতে দিনের সূচনাতেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এ,বি,সি। নিশ্চয় তাদের মস্তিষ্করস আজ সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের শিকার। ইহুদী-খ্রিস্টানদের নীল ষড়যন্ত্রে তা পূর্ণ আচ্ছন্ন!
বিভিন্ন নামে বর্তমানে বের হয়েছে অসংখ্য কিন্ডার গার্টেন। ছোট ছোট গলিতেও কিন্ডার গার্টেনের ছড়াছড়ি এই মুসলিম ভূ-খণ্ডে! এদের ক্লাস শুরু হয় যখন মকতবগুলোর ক্লাস শুরু বা মাঝসময়ে। অথবা সেই ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় তাদের কোচিং সেন্টারের ক্লাস। চরম ধোঁকাপূর্ণ তাদের এই ক্লাসবিন্যাস। শিশুরা স্কুলে যাওয়ার তাগাদায় বাধ্য হয় মকতব ছাড়তে। দীনি শিক্ষাঙ্গণ ছেড়ে তারা ছুটে যায় অন্য শিক্ষার পিছে। অভিভাবকরাও বাধ্য হয় সন্তানকে দীনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে। প্রতিদিন সকালে তারা নিষ্পাপ শিশুটির আঙ্গুল ধরে নিয়ে যায় পাপের প্রাথমিক কেন্দ্রে! মাস সমাপ্তির পর দেয় মোটা টাকা। এভাবে একদিন তারা সাচ্ছন্দ্যবোধও করে। খুশি হয় এই ভেবে যে, ছেলেটা এ,বি,সি শিখছে, বড় হয়ে ডাক্তার হবে, এই সেই হবে! কী যে আনন্দ তাদের! দীনহীনতার কারণে এই ছেলেটিই যখন নিজ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসবে তখনও হয়ত তারা আনন্দই প্রকাশ করবে!
কিন্ডার গার্টেনগুলিকে একপ্রকার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মনে হয় আমার। ভালো ব্যবসা হয় তা দিয়ে। পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া অনেক যুবককেই দেখা যায় ফুটপাতের কিন্ডার গার্টেনে শিক্ষকের আসনে। পাড়ার অনেক বেকার ও ব্যর্থ ছেলে-মেয়ে থাকে এই কিন্ডার গার্টেনগুলোর শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত। এতো ভালো ব্যবসা থাকলে পড়া-লেখার কী আর প্রয়োজন! কোনোরকম ক্লাস ডিঙ্গিয়ে সার্টিফিকেটটা পেয়ে গেলেই তো হলো! কিন্ডার গার্টেন তো আছেই চাকরি দিতে! আর বাবার জায়গা বা বসা থাকলে তো কিন্ডার গার্টেন দেওয়া কোনো ব্যাপারই না!
অনেক অভিভাবকের ধারণা কিন্ডার গার্টেনের পড়া ও পড়ানোর ধরণ বেশ উন্নত। মানলাম তা বেশ উন্নত। কিছু ভালো প্রতিষ্ঠান তো থাকবেই। তা অস্বীকার করার সাধ্য নেই কারও। তবে সবচে মজার কথা হলো এসব অভিভাবকদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আপনি কি কোনো কিন্ডার গার্টেনে পড়েছেন ? জবাব তখন "না" সূচক আসবেই। অথচ তিনিও উঁচু দরের শিক্ষিত। মকতব পড়তেন, স্কুলে যেতেন। তবে কেন তারা সন্তানদের জন্য মকতবকে বাদ দিয়ে ভোরে কিন্ডার গার্টেনে নিয়ে যায় বুঝে আসে না!
আমাদের পূর্বসূরীরা কিন্ডার গার্টেন দেখেইনি হয়ত। তবুও তারা বড় শিক্ষিত হয়েছেন। কেউ ডাক্তার, কেউ মাস্টার! আমরা কেউ কেউ হয়ত সাহস করে বলে ফেলতে পারবো তাদের ডাক্তারি বা মাস্টারি ত্রুটিযুক্ত! হ্যাঁ আমি বিশ্বাস করি তাদের ডাক্তারি বা মাস্টারি ত্রুটিহীন নয়। ত্রুটিহীনতা মানুষের আলামত নয়। তারা অবশ্য মানুষ। আর আজকের কিন্ডার গার্ডেন পড়ুয়া ছেলেগুলো যে বড় ও নিখুঁত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাচ্ছে এমনও নয়। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী গোল্ডেন A+ পাচ্ছে, কত বিজ্ঞানাগার, গবেষণাগার বানানো হয়েছে দেশের কত প্রান্তে, অথচ দেশে সফল বিজ্ঞানী নেই, দক্ষ গবেষক নেই, নেই ভালো উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার লোক! তাহলে ঐ কিন্ডারওয়ালারা গেলো কোথায় যারা গোল্ডেন অর্জন করেছিলো ? বড় আশ্চর্য লাগে ভাবতে!
শিশুর আভিভাবকের প্রতি আবদার:
আপনারা শিশুর বাবা, মা, ভাই, ইত্যাদি। শিশুর ভবিষ্যত নির্মিত হবে আপনাদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। আপনার সন্তানের সফলতা আপনার সফলতা। তার ব্যর্থতা আপনার ব্যর্থতা। তাদের ভবিষ্যতগুলি নির্মাণ করার দায়িত্ব আপনাদের। ছোট গাছ-লতাকে যেদিকে নিবেন সেদিকেই তা বাড়বে। আপনাদের সন্তানরাও কচি গাছ-লতার ন্যায়। তাদের মস্তিষ্কগুলিতে যা দিবেন তাই গিলবে। ভালো দিলে ভালো, মন্দ দিলে মন্দ।
আপনার শিশু থেকে সফলতা, আদব, উন্নত চরিত্র, নিষ্ঠা, সততা ও আমানতদারিতা আশা করেন বলেই বিশ্বাস। প্রতিটি বাবা-মা তাই চায়। এই চাওয়ার পূর্ণতা পেতে আপনার শিশুকে দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করুন। অন্তত দীনের প্রাথমিক শিক্ষাটা দেন তাদের। অন্যথায় শত দুঃখ ও হতাশার সম্মুখীন হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন। আপনার শিশুকে দীনি শিক্ষা না দিলে একদিন চোখের অশ্রু না হলেও হৃদয়ের অশ্রু ফেলতে হবে নীরবে রাতের কোনো প্রহরে একা একা।