| |
               

মূল পাতা আরো সম্পাদকীয় কর্মগুণে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ


নিন্দুকদের মুখেও যার জয়গান

কর্মগুণে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ


মুফতি এনায়েতুল্লাহ     22 January, 2022     08:29 PM    


সাদামাটা চোখে দেখলে, স্বাভাবিকভাবে মনে করলে আর অন্য দশজন আলেমের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য নেই। বরং লোকদেখানো কর্মকাণ্ডে তিনি অনেকের থেকে বেশ পিছিয়ে। কিন্তু একজন শাগরেদ, একজন ছাত্র, একজন ভক্ত, একজন গবেষক কিংবা শিক্ষানুরাগী সমাজ সচেতন মানুষের কাছে তিনি প্রবাদপুরুষ। প্রচলিত রাজনীতির মাঠে তিনি নেই। মাঠে-ময়দানে তার মঞ্চ কাঁপানো ভাষণ আর হুংকার শোনা যায় না। কিন্তু গবেষণার জগতে, লিখনির ময়দানে তিনি রাজ করে চলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা কারিকুলাম বা নেসাব জাতিকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। তার লিখিত পাঠ্যবই থেকে শুরু করে অন্যসব বই সর্বমহলে স্বীকৃত।

বলছি আদিব সাহেব হুজুর নামে খ্যাত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহর কথা। মাওলানা আবু তাহের মিসবাহকে নতুন করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আমার সৌভাগ্য হয়েছে কিছু সময় তার সান্নিধ্যে থাকার। দিনটি শুক্রবার। খুব কাছাকাছি সময়ে (২০০৬, ফেব্রুয়ারি) দু’জনই বাবা হারিয়েছি। ওই সময়টাতেই হুজুরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। জুমার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আলাপ। বিদায়ের সময় তার দেওয়া উপহারগুলো এখনও আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, আজকের প্রসঙ্গ একটু ভিন্ন। নিভৃতচারী কিন্তু যুগসচেতন এই আলেমের চিন্তার ফসল মাদানি নেসাব। এই নেসাবে পড়াশোনা করা হাজার হাজার আলেম বাংলাদেশে বিদ্যমান। সাক্ষাতকালে আমি জানতে চেয়েছিলাম, মাদানি নেসাব আসলে কী। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘মাদানি নেসাব হলো- ফনভিত্তিক ছাত্র গড়ার একটা প্রচেষ্টা।’ আমি মনে করি, এটা এখন আর প্রচেষ্টার কাতারে নেই, এটা এখন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমি মাওলানা আবু তাহের মিসবাহর ছাত্র নই। আমি তার কর্মের, তার সাধনার, তার সৃষ্টির গুণমুগ্ধ এক দর্শক। হাজার হাজার শাগরেদ গড়েছেন তিনি একক প্রচেষ্টায়, একক উদ্যোগে, একক সংগ্রামে। এ জন্য অবশ্য তাকে কম কষ্ট সইতে হয়নি।

জন্ম তারিখ হিসেবে (১৯৫৬ সাল, ৬ মার্চ) এখন তার বয়স ৬৫। ১৯৭৭ সালে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেছেন, মানে এখন থেকে ৪৩ বছর আগে। শিক্ষকতার শুরু যাত্রাবাড়ি মাদরাসায়। পরে মালিবাগ হয়ে হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠিত জামিয়া নুরিয়া (মাদরাসা-ই-নুরিয়া) শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে দুই যুগের (২৫ বছর) বেশি সময় শিক্ষকতা করেন। তখন থেকে তিনি মাদানি নেসাবের পরীক্ষামূলক কিতাব রচনা শুরু করেন এবং পরে ১৯৯২ সালে নূরিয়া মাদরাসা ছেড়ে আল্লামা আবদুল হাই পাহাড়পুরী (রহ.)-এর নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা করেন মাদরাসাতুল মদিনা। জন্ম নেওয়া মাদানি নেসাব এখানে যত্নের সঙ্গে বড় হতে থাকে। একছেলে (মাওলানা মুহাম্মদ) ও দুই মেয়ের বাবা মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ সম্পর্কে আমার চেয়ে তার শাগরেদরা ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু তার সাধনা ও কর্মের বিষয়ে আমার উপলব্ধির কথাটা ব্যক্ত করতে চাই। কেন তিনি অনন্য, কেন তিনি সফল সেই কারণটা খুঁজে বের করতে চাই।

তিনি একজন গবেষক। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করে নুতন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছেন। এ জন্য কিন্তু তিনি কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করেননি। নিজের কাজটা নিজে আপন মনে, আপন গতিতে করে গেছেন। তার কাজগুলো সমাজ গ্রহণ করেছে নিজ উদ্যোগে। কাউকে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। মাদানি নেসাব চালুর জন্য কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। মার্কেটিং করা হয়নি। এই নেসাবের বইগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য উপকারি বলেই মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তা সন্নিবেশিত করেছেন। এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো- কাজকে একনিষ্ঠভাবে করা। নিজের কাজে শতভাগ নিবেদিত থাকা। কাজের সফলতার জন্য বহুমুখী কাজে না জড়ানো। স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তক মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ নিজ প্রতিভা ও কর্মদীপ্ততায় উজ্জ্বল। এমন গুণী ও ব্যতিক্রমী মানুষ সমাজে কমই হয়। অনেক বোর্ড, অনেক নেতা, অনেক কমিটি, সাব-কমিটি যেটা পারেননি। মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ সেটা নীরবে করে দেখিয়েছেন। এ জন্য তার কোনো অহঙ্কার নেই, কোনো গর্ব নেই। কোনো পদ কিংবা স্বীকৃতিও তিনি চাননি। ইতিহাসে বরণীয় হয়ে থাকবেন, বাংলাদেশে দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী ও নির্দিষ্ট একটি কাঠামোতে রূপদানের জন্য।

এখনতো আমরা কোনো কাজ শুরু আগে হাঁকডাক, প্রচার-প্রসার শুরু করি। আর কাজটি করে ফেললে তো কেল্লাফতে। কিন্তু আবু তাহের মিসবাহ ব্যতিক্রম। তিনি হাতে লেখা আরবি পত্রিকা বের করেছেন (ইকরা) শুধুমাত্র ছাত্রদের কল্যাণের জন্য। আর মাসিক পুষ্প নিয়ে তো আলাদা রচনা ছাড়া কথা বলাই দুষ্কর। শুধু এতটুকু বলি, পুষ্পের সেই প্রেরণা থেকেই এখন মাদরাসা থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী বের হচ্ছে, তরুণ আলেমদের হাতে কলম উঠেছে। এভাবেই কর্মগুণে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা মাওলানা মিসবাহ ইতিহাসের এক মহাপরম্পরায় যুক্ত হয়েছেন মহান পূর্বসূরিদের কাতারে। সদা বিনয়ী এই মানুষটি চিন্তাগতভাবে লালন করেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবীকে। নিজ জীবনের কর্মযজ্ঞের প্রেরণাদাতা হিসেবে নদবীর (রহ.) কথাই উঠে এসেছে তার কলমে। তাই তো আলী নদবীর চিন্তাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে তিনি সদা ব্যাকুল।

লেখালেখির ক্ষেত্রেও মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করেননি। পাঠ্যবই ছাড়া তিনি অনবদ্য কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার অন্যতম হলো- সফরনামা বাইতুল্লাহর মুসাফির। এই বইয়ের আবেগমিশ্রিত গদ্য যেকোনো পাঠককে বিমোহিত করে। এতসব মহৎ কীর্তির জন্য তিনি তরুণ সমাজের কাছে স্বপ্নের পুরুষ। প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে মূল স্রোতের দিকেই ছিল তার গন্তব্য। ফের তিনি যেভাবে কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে সফলতার শিখরে পৌঁছেছেন, সেখান থেকে রয়েছে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু। নিন্দুকদের মুখে তার জয়গান তো আর এমনি এমনি উঠেনি? এটাকেই বলে, কথা নয়- কাজের মূল্যায়ন।

আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজের মূল্যায়ন বা স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পদক দেওয়া হয়। নানাভাবে সম্মান জানানো হয়। আমার সামর্থ্য, ক্ষমতা থাকলে আমি প্রচলিত কোনো পদক কিংবা সম্মাননা নয়, ভিন্নভাবে তাকে সর্বোচ্চ সম্মান জানাতাম। এটা আমার অনুভূতি, এই অনুভূতির সঙ্গে অন্যের অনুভূতি মিলতে হবে, এটা জরুরি না। আর মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ সম্মাননার জন্য উন্মুখ না। তিনি পার্থিব সম্মান তো অর্জন করেছেন, দেশের লাখ লাখ তরুণের রাহবারে পরিণত হয়েছেন। এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে? এবার শেষ করবো, মাওলানা আবু তাহের মিসবাহর একটি কথা দিয়ে। আমি বলেছিলাম, আমাকে একটি নসিহত করুন। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষকে ক্ষমা করা, মানুষের সঙ্গে ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাতে দু’টো লাভ, প্রথমত আল্লাহ খুশি হন। দ্বিতীয়ত, এটা নিয়ে আর সময় নষ্ট হলো না। আপনি আপনার কাজে মনোনিবেশ করতে পারলেন সুকুনের সঙ্গে, দিলে পেরেশানি অনুভব হলো না। ক্ষমার গুণে মানুষ অনেক উচুঁতে উঠতে পারে।’

লেখক : সাংবাদিক