| |
               

মূল পাতা সফর বনের নাম দুধপুকুরিয়া


বনের নাম দুধপুকুরিয়া


ইশতিয়াক হাসান     19 November, 2020     11:39 AM    


মনিরুল ভাইয়ের মুখে দুধপুকুরিয়া নামটা শোনার পরেই গেঁথে গিয়েছিল মনে। এমন সুন্দর নামের যে কোনো বন আছে বাংলাদেশে এটাই জানতাম না। অনেকটা শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের বিভিন্ন জায়গা যেমন কুঞ্জপুকুর, দুধসয়ার দ্বীপ এসবের কথা মাথায় চলে আসছিল। এমন চমৎকার যে অরণ্যের নাম সে ও নিশ্চয় অনেক মনোহর! ভেবেছিলাম সময়-সুযোগ পেলে যেতে হবে। হাতিদেরও নাকি বেশ সহজে দেখা মেলে ওখানে। রাঙ্গামাটি-বান্দরবান রাস্তায় বাঙ্গালহালিয়া পেরিয়ে আরো অনেকটা গিয়ে জঙ্গলটা, পড়েছে বান্দরবানের সীমানায়।

সালটা ২০০৯-১০, কাপ্তাইয়ে বেড়াতে গেলে সেখান থেকে এক সকালে রওয়ানা হলাম বাঙ্গালহালিয়ার দিকে, একাই। প্রথমে চন্দ্রঘোনায় এসে কর্ণফুলী নদী পেরোলাম ফেরিতে চেপে। স্বচ্ছ কর্ণফুলীর জল কেটে ঢিমেতালে ফেরির এগিয়ে চলা, দূরে পাহাড়ের রেখা এসব দেখতে দেখতে সময়টা কেটে গেল ফুরুত করে।

ওপাড়ে এসে একটা টেম্পোতে বাঙ্গালহালিয়া। পরের বাহন একটা চান্দের গাড়ি। গাদাগাদি করে তোলা হলো জনা কুড়ি নারী-পুরুষ। যাত্রীদের মধ্যে নিজেকে একমাত্র বাঙ্গালী হিসাবে আবিষ্কার করে ভারি মজা পেলাম। বুড়ো এক মারমা নারী আবার একটা ছাগলও সঙ্গে নিয়ে নিয়েছেন। দুধপুকরিয়ায় যে জায়গায়টায় আমার নামার কথা সেটাকে ডাক বাংলোর মোড় বলে। ওখানেই আমাকে ছেড়ে গেল চান্দের গাড়ি।

চারপাশে গাছপালার মাঝখানে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাকা সড়ক। ছড়ার ওপর সুন্দর এক সেতু। ওটা পেরিয়ে চারপাশে তাকালাম। বামে একটু দূরে গাছপালার ফাঁকে পুকুর, বাড়িঘর নজর কাড়ল। ডানে উঁচু উঁচু গাছপালার মাঝে মাঝে কয়েকটা পুরনো কাঠ-বাঁশের আশ্রয়। বুঝতে পারলাম এগুলো ফরেস্টের অফিস ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জায়গা। এখানে একটা পুরনো ব্যবহার অযোগ্য বাড়িকে বন বিভাগের বাংলো বলে চিহ্নিত করতে পারলাম। বুঝলাম এই পরিত্যক্ত ঘরটা থেকেই এর নাম ডাক বাংলোর মোড়।

গাছের ডাল মাটিতে ফেলে সিঁড়ির মত বানানো হয়েছে, এই পথে উঠে এলাম টিলা মতো জায়গাটিতে। একটু খোঁজাখুঁজি করতে বিট অফিসারকে পেয়ে গেলাম। বছর চল্লিশেকের, আলাপী কর্মকর্তাটি নিরাশই করলেন। বললেন, বনের ভেতর হাতির পাল আছে। খাবারের অভাবে মেজাজ এখন বড্ড চড়া। পাহারা ছাড়া আমাকে জঙ্গলে ঢুকানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু যে কয়েকজন বনপ্রহরী আছে সবাই গেছে কোনো না কোনো দিকে টহলে।

তাঁকেও যেতে হবে। তবে চাইলে ডানে বনে ঢুকার মুখে কয়েকটা ছবি তুলতে পারি। এতোটুকুন সময় রাইফেল নিয়ে সঙ্গেই থাকবেন। আমার কারণে একটা পর্যটক দলের ও ডানে শ খানেক গজ ভেতরে মূল জঙ্গলে ঢুকার পথটায় আসার সুযোগ হলো। বিশাল এক গাছের পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ ঢুকেছে অরণ্যে। এখানেই হাতির নাদি পড়ে থাকতে দেখলাম। একটু পর বিট অফিসারসহ ফিরে এলাম পাকা সড়কে।

কী করা যায় ভাবতে ভাবতে রাস্তা ধরে কতকটা এগুতেই পেলাম এক দোকান। সেখানে বসে চা খেতে খেতে দোকানি ও খদ্দরদের জানালাম সমস্যার কথা। তখনই এক বুড়ো বললেন, ও এই কথা দুইটা পোলারে লইয়া যাও, কিছু বকশিশ দিয়ে দিও, ওরা এখানকার পোলাপান, জঙ্গলেই কাটায় দিনের বেশিরভাগটা।

তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই চোখ গেল ডান পাশের জটলার দিকে। কয়েকটা ছেলে বসে গুলতানি মারছিল। এদের মধ্যে দুই কিশোর এসে পাশে দাঁড়াল। একজন বলল, ‘চলেন যাই।’ তাকালাম ওর দিকে, শ্যামলাবরন, পড়নে লুঙ্গি, মুখে আন্তরিক হাসি। পাশের ছেলেটারও পোশাক একই ধরনের, লুঙ্গির ওপর শার্ট চাপিয়েছে। গায়ের রং সঙ্গীর তুলনায় একটু ময়লা।

বিট কর্মকর্তাকে একটু আগে একটা বাইক নিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছি, অতএব দ্বিধাহীন চিত্তে দুই সঙ্গীসমেত বড় গাছটার পাশের ওই পথ ধরেই ঢুকলাম অরণ্যে। এতোক্ষণ রোদের আঁচ ছিল বেশ, তবে দুধপুকুরিয়ার অরণ্যে ঢুকতেই গাছপালার ছায়ারা আমাদের ঘিরে ফেলল। কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। আমার দুই কিশোর বন্ধুর নামটা ভুলে গেছি এতো দিনে, তবে কিছুক্ষণের মধ্যে দারুন ভাব হয়ে গেল ওদের সঙ্গে। চলমান ধারাবিবরনী দিচ্ছিল আর হাঁটছিল ওরা, ‘এইটা হলো শিমুল গাছ। ওই যে দেখছেন বালুর ওপর ছাপ, ওইটা মায়া হরিণের।’ এমনই নানান কথা।

কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেলাম বন ও এর বাসিন্দাদের সম্পর্কে সত্যি ওরা ওয়াকিবহাল। একজন বলল ওর দাদা বড় বাঘের গল্প বলে। গরু ঘাড়ে কামড়ে ধরে নিয়ে যেত পাহাড়ের আস্তানায়। এমন সময় একটা ধাতব ঢং ঢং শব্দ হলো। কী ওটা জিজ্ঞেস করতেই একজন আমাকে নিয়ে গেল পাহাড়ের ঢালে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, গরু চরছে কয়েকটা, গলায় বাধা ঘন্টাই আওয়াজের কারণ। ভাবলাম বছর ত্রিশ-চল্লিশ পেছনে ফিরে গেলেই হয়তো এভাবে নিশ্চিন্তে গরু ছেড়ে রেখে যেতে পারত রাখাল। চিতা বা বাঘ কখন সাবরে দিত এই ভয়ে পাহারায় থাকতে হতো ধারেই।

পথের দুই পাশে গর্জনসহ বেশ কিছু বড় গাছ আছে। ভেতর দিকে ছোট গাছ, বড় গাছ, ঝোপ-জঙ্গল সব কিছুই নজর কাড়ল। কিছু অর্কিডও দেখলাম। এক জায়গায় একটা গাছের কাটা গুড়ি দেখিয়ে ওরা উষ্মা প্রকাশ করল, গাছচোরের কাটা। তারপরই এলো যথারীতি হাতির প্রসঙ্গ। দুধপুকুরিয়ায় এখন দাপুটে জন্তুর মধ্যে কেবল টিকে আছে হাতিই। আমাকে কথা দিল, ওরা বুনো হাতি দেখিয়ে ছাড়বে। তবে হাতিরা এর জন্য এই বনে থাকতে হবে। মাঝের ধানি জমি পেরিয়ে অন্য কোনো জঙ্গলে চলে গেলে মুশকিল।

হাতিদের সম্পর্কে ওরা রীতিমত বিশেষজ্ঞ। বলল হাতি প্রচণ্ড জোরের দৌড়াতে পারে। বিশালদেহী জন্তুটা পাহাড়ের ওপরের দিকে আর আপনি নিচে থাকলে, নিরাপদ ভাবার কোনো কারণ নেই নিজেকে। কারণ ওরা নাকি অদ্ভুত কায়দায় ছেচড়ে নেমে আসে দ্রুতগতিতে।

তো হাতির খোঁজে খুব সাবধানে পা চালাচ্ছি। কোথাও একটু-আধটু শব্দ হলে আরো সতর্ক হয়ে যাচ্ছি। বিশালদেহীদের নাদি চোখে পড়েছে কয়েক জায়গাতেই। তবে সব দুই দিনের পুরনো। বসন্তবাউরি, টিয়া, কাঠঠোকরাসহ কিছু পরিচিত পাখি, আর স্তন্যপায়ীর মধ্যে এক জোড়া বানর ও গোটা কয়েক কাঠবিড়ালি এখন পর্যন্ত আনন্দ দিয়েছে আমার বন্যপ্রাণীপ্রেমী মনকে।

এরপরই শীতল জলের একটা ছড়ায় নামলাম আমরা। পা ডুবিয়ে হাঁটতে ভারি আনন্দ হচ্ছিল। এখানে-সেখানে মাকড়সারা জাল পেতেছে, ছোট ছোট পতঙ্গরা ধরা পড়েছে তাতে। এই জলের পথ দিয়ে অনেকটা হাঁটলাম, কান খাড়া হাতি বা অন্য কোনো বন্য জন্তুর খোঁজে। ওদের বক বক চলছেই। বড় সম্বর আর আছে কিনা জানে না, তবে আগে শিকার করত লোকেরা। হাতিদের খাবার নেই বনে, এই বনে এক হপ্তাহ, ওই বনে দুই-চারটা দিন কাটায়, কখনো আবার রাতে হামলে পড়ে ধানক্ষেতে। বিশাল পেট এভাবেই ভরানোর চেষ্টা চলছে।

ওদের বলেছিলাম আমার হাতে সময় খুব বেশি নেই। যখন ছড়া পথ ধরে উঠলাম, আবিষ্কার করলাম সেতুটার কাছে উঠে এসেছি। পথের পাশে বড় একটা ছড়া দেখেছিলাম, ওটারই সরু অংশটা ধরে হেঁটেছি এতোটা সময়, বুঝতে অসুবিধা হলো না। একটু পরই উল্টো দিক থেকে বাঙ্গালহালিয়াগামী একটা চান্দের গাড়ি হাজির হতেই চেপে বসলাম। হাত নাড়ল ওরা, আর সমস্বরে চেঁচাল, ‘আবার আইসেন, পরের বার হাতি মিস হইব না।’ একজনের বাবার নাম্বারও দিয়েছিল। ওটা হারিয়ে ফেলেছি, তাই ওদের সঙ্গে যোগাযোাগ হয় নি আর, তেমনি হাতি দেখতে আর যাওয়া হয় নি দুধপুকুরিয়া।

রাঙ্গামাটি-বান্দরবানসহ বিভিন্ন এলাকায় হাতিরা কোনঠাসা হয়ে পড়ছে বহুদিন হলো। কক্সবাজারে বছর কয়েক আগেও সংখ্যায় ছিল বেশ ভারি। তবে এখন মারা হচ্ছে যেভাবে চিরতরে হারাতে খুব দেরি নেই! গত কয়েক দিনের মধ্যে তিনটাকে হত্যা করেছে লোভী মানুষেরা। নিশ্চয় দুধপুকুরিয়ার হাতিরাও ভালো নেই! আইইউসিএনের ২০১৬ সালের জরিপে গোটা দক্ষিণ পার্বত্য চট্টগ্রামে কেবল গোটা ত্রিশেক হাতির কথা বলেছিল! এখন হয়তো আরো কমেছে! যদি জঙ্গলটায় যান হাতিদের আমার শুভেচ্ছা দেবেন, আর বন ও হাতিদের ভালোবেসে, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে ঘুরাফেরা করবেন, এই চাওয়া।