| |
               

মূল পাতা সোশ্যাল মিডিয়া পুনর্গঠিত হেফাজত: প্রত্যাশা ও সংশয়


পুনর্গঠিত হেফাজত: প্রত্যাশা ও সংশয়


মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী     18 November, 2020     08:29 PM    


গত ১৫ই নভেম্বর ২০২০, রবিবার পুনর্গঠিত হলো হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি। চট্টগ্রামের দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে উক্ত পুনর্গঠন হয়। মূল-কমিটিতে কারা-কারা স্থান পেয়েছেন, তা এখন অজানা নয়। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আমীর হিসাবে সাবেক মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং মহাসচিব হিসাবে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী নতুন কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছেন। পুনর্গঠিত কমিটি নিয়ে আপাতত যা জেনেছি: দু’একটা বিষয় বাদ দিলে বাকি সব চলনসই—এমন মতামত অধিকাংশের। মোটের উপর আল্লামা আহমদ শফী রহ.-র ইন্তিকালের পর হেফাজতের পুনর্গঠন নিয়ে সবার যে দাবি ছিলো, সেটার উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

পুনর্গঠিত হেফাজত নিয়ে বলতে গেলে বাস্তবতার খাতিরে কিছু কথা বলতে হয়—যা একজন পর্যবেক্ষকের নিরপেক্ষ ও ব্যক্তিগত মতামত হিসাবে গ্রহণ করলে বিতর্কের কিছু থাকে না। বলাবাহুল্য, বর্তমান বছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর সাবেক আমীর আল্লামা আহমদ শফী রহ. ইন্তিকাল করেন। সেই থেকে হেফাজতে ইসলামের আমীরের পদ শূন্য। তখন থেকে জাতি তাকিয়েছিলো হেফাজতে ইসলামের ভবিষ্যৎ আমীর নির্বাচনের দিকে। সংগতকারণে, গত ১৫ই নভেম্বর, রোববার হাটহাজারী মাদরাসায় মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী দা.বা.-র আহ্বানে পুরো দেশের জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের নিয়ে আমীর নির্বাচন ও কামিটি গঠন বা পুনর্গঠনের নিমিত্ত একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দৃশ্যমান আদ্যপান্ত একজন কাউন্সিলর হিসাবে সশরীরে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। একজন ব্যক্তি হিসাবে আমার নিজস্ব স্ভাব, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে সম্মেলনের কিছুকিছু বিষয় যেমন ইতিবাচক মনে হয়েছে তেমনি নেতিবাচক বা অসামঞ্জস্যশীলও মনে হয়েছে। বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে সেসব এখানে এখনই না বলা শ্রেয় বলে মনে করি। একটি সংগঠনের সাংগঠনিক মেজাজকে নিরীক্ষণ করলে, বিশেষত, আল্লামা আব্দুস সালাম চাটগামী (আ’লাল্লাহ মাকামাহু), ড. আফম খালিদ হোসাইন সাহেব, মাওলানা সাজিদুর রহমান সাহেব, ঢাকার মাখযানুল উলূম মাদরসার পরিচালক মাওলানা নুরুল ইসলাম সাহেব প্রমূখের বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। আল্লামা চাটগামী দা.বা. তাঁর উর্দূতে দেয়া বক্তব্যে একটি শরয়ী দস্তূর এবং সেই দস্তূরের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলে ‘আকদ’র প্রসঙ্গ টেনেছেন। আমার মনে হয়েছে, পুরো সম্মেলনে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা। হযরতের কথায় তিনটি বিষয় উঠে এসেছে--এক, শরীয়াহভিত্তিক দস্তূর; দুই, আকদ এবং তিন, আকদের প্রতি দায়বদ্ধতা। কোন সংগঠনই দস্তূর বা সংবিধান ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। অথচ হেফাজতে ইসলাম তার দীর্ঘ পথচলায়ও পূর্ণাঙ্গ একটি গঠনতন্ত্র পাশ করতে পারেনি। ড. খালিদ ভাইও সে-কথা বললেন তাঁর বক্তব্যে। এরপর আসে আকদ বা সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বিষয়, যা সাংগঠনিক-মনস্তাত্বিক ইজাব-কবূলকে চিহ্নিত করে। এটি সংগঠনের মৌলিক স্তম্ভগুলোর একটি। হযরত চাটগামী দা.বা.-র কথা মানলে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সাংগঠনিক শপথ নেয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। শপথ নেয়া কোন প্রতীকী কর্ম নয়, বরঞ্চ গঠনতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের দলীল। এটাকে ইচ্ছাকৃত লঙ্ঘন করা হলে, লঙ্ঘনকারীকে ‘বা-গী’ বা বিদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করা যায়। সুতরাং, নির্দ্বিধায় বলা যায়, আল্লামা চাটগামীর উক্ত মৌলিক নির্দেশনায় হেফাজতে ইসলামের ভবিষ্যৎ পথচলার নিরাপত্তা অনেকখানি নির্ভর করে।

যা হোক, প্রতিনিধি সম্মেলনের কথায় ফিরে আসি। আগেই বলেছি, হেফাজতে ইসলামের সম্মেলন নিয়ে জাতির প্রত্যাশা ছিলো চোখে পড়ার মতো। যা কিছু হয়েছে, আমি বলবো পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তবে এমন কিছু প্রত্যাশা আমরা মনেপ্রাণে কামনা করি—এখানে বলতেই হচ্ছে:

১. পুনর্গঠিত কমিটি যাচাই-বাছাইকরণ: কোন কাজ-ই এক লাফে হয় না; ধীরেধীরে-ধাপেধাপে করতে হয়। ১৫ই নভেম্বরের পুনর্গঠিত কমিটিকে আরেকবার যাচাই-বাছাইয়ের কষ্টিপাথরে পরখ করে নিলে ভাল হয়। যেমন ধরুন, যেহেতু সারা দেশ থেকে দায়িত্বশীল নেয়া হয়েছে, তাই প্রথম ধাপে কিছুকিছু ক্ষেত্রে এলোমেলো হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমনটি হতেই পারে। দেখতে হবে, কোন দায়িত্বশীল কোন দায়িত্বশীলের নিকটবর্তী থাকলে কাজ সম্পাদনে সহজতা আসে। কোন-কোন দায়িত্বশীল কেন্দ্রে থাকবেন, কোন-কোন দায়িত্বশীল রাজধানীতে থাকবেন—সেসব বণ্টন করতে হবে ‘তরীকায়ে কা-র’-র পথচিত্র তৈরি করে। মনে রাখতে হবে, তাকসীমে কা-র বাস্তবায়িত হবে তরীকায়ে কা-রের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে। সঙ্গতকারণে, কার্যকরী কমিটির প্রথম বৈঠকেই এ বিষয়টির সমাধান করা হলে আশা করি ভাল ফল বয়ে আনবে।

২. সাংগঠনিক বলয় সুসংহতকরণ: স্বীকার করতে হয়, সাংগঠনিক বিস্তৃতি বা শক্তিশালী সাংগঠনিক পথরেখা প্রস্তুতকরণ একটি আদর্শ সংগঠনের প্রাণ। সাধারণত সাংগঠনিক সম্পাদক এ কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এ-কাজে সফল হতে সাংগঠনিক সম্পাদকের দক্ষতার বিকল্প নেই। বলা যায়, এ-দিকটায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান বেশ দুর্বল বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আজও দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলা-মফস্বল কমিটি গঠন, কমিটির নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানে তদারকি, সাংগঠনিক সম্পাদকের দেশব্যাপী ত্রৈমাসিক সফর, কমিটিগুলো থেকে তরুণ-নেতৃত্ব ও কর্মী গড়ে তোলা, কর্মীদেরকে সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা ইত্যাদিতে সন্তোষজনক কাজ করা হয়নি বলে মনে হয়। পাশাপাশি আমাদের দেশের ভূ-বিবেচনায় সাংগঠনিক সম্পাদকের অবস্থান রাজধানীতে হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু রাজধানী সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, তাই নির্বাচিত সাংগঠনিক সম্পাদক রাজধানীতে বসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারবেন—যা দেশের অন্য কোথাও বসে মানোত্তীর্ণ করা দুষ্কর। বিষয়টি আশা করি পুনর্গঠিত হেফাজত নেতৃবৃন্দ ভেবে দেখবেন। এখানে আমার একটি প্রস্তাবনা আছে। তা হলো, একজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে ঢাকায় রেখে ৮টি বিভাগে ৮ জন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের মাধ্যমে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেতে পারে। এতে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের উপর থেকে কাজের চাপ কমবে এবং বৃহত্তর পরিসরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সহজ হবে।

৩. জবাবদিহিতা: জবাবদিহিতা একটি প্রতিষ্ঠানের মূল-নিয়ামক। যেখান জবাবদিহিতা নেই, সেখানে সততা নেই; যেখানে জবাবদিহিতা আছে, স্বচ্ছতা আছে—সেখানে সততা আছে, প্রগতি আছে, সফলতা আছে। হেফাজতের আঙ্গিকে জবাবদিহিতা হবে প্রথমত, স্বয়ং রব্বুল আলামীনের কাছে এবং দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের কাছে--যেখানে প্রত্যেক দায়িত্বশীল দায়িত্বের পরিধি অনুসারে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য হবেন। মনে রাখতে হবে, কেবল অর্থের হিসাবেই জবাবদিহিতা বন্দী নয়। এর বাইরেও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, হেফাজতে ইসলাম কোন পেশাধারী প্রতিষ্ঠান নয়; এখানে কেউ বেতনধারী চাকরিজীবি (ব্যতিক্রম বাদে) নন। তাই, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক আইন প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবামূলক আন্তরিক প্রচেষ্টা। এখানটায় কোন প্রকার ঘাটতি দেখা দিলে পুরো ব্যবস্থাই ধসে যেতে বাধ্য। বিশেষ করে, কমিটির প্রতিটি বৈঠকে পূর্বের বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তাবয়ন নিয়ে পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরী। যদি এমন নিয়ম করা হয় যে, পূর্ববর্তী বৈঠকের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ব্যতিরেকে চলমান বৈঠক শুরু করা যাবে না, তাহলে কাজে স্বচ্ছতা আসবে। প্রত্যেক বৈঠকের নির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিক খাতায় বৈঠকের বিবরণী দফতর সম্পাদক কর্তৃক লিখিত ও সংরক্ষিত থাকতে হবে এবং বিবরণীর অনুলিপি বা নকল মহাসচিব বরাবরে জমা দিতে হবে।

৪. পূর্ণাঙ্গ হিসাবের অডিট: সময়ে-সময়ে যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ওঠে তা হলো: হেফাজতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আয়-ব্যয়ের হিসাব। ২০১৩ সাল থেকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অডিট রিপোর্ট আমার যদ্দূর জানা আছে এখনও চূড়ান্ত করা যায়নি। বারবার কমিটি গঠন, সভাপতি পরিবর্তন, সদস্য পরিবর্তন, অযাচিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে অডিট চূড়ান্তের বিষয়টি আর এগোয়নি। চট্টগ্রামের একজন দায়িত্বশীল যিনি এখন মূলধারাবিরোধী, মতান্তরে ২২ লক্ষ বা ২৬ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে হিসাব না দেয়ার বিষয়ে পূর্বতন কেন্দ্রীয় কমিটি কোন ব্যবস্থা নেয়নি, যা আজও অনিস্পন্ন হয়ে রয়েছে বলে আমি জানি। বিষয়টি সাবেক অর্থ সম্পাদক বা কোষাধ্যক্ষ থেকে জেনে নেয়া যেতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, হেফাজতের এসব অর্থ মুসলিম সর্বসাধারণের—কারও ব্যক্তিগত নয়। তাহাফ্ফুযে আমওয়ালুল মুসলিমীন বা মুসলিম উম্মাহর সম্পদ রক্ষার যে অনিবার্য দায়িত্ব হেফাজতের কাঁধে বর্তেছে তার জন্য জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো, বর্তমান পুনর্গঠিত কমিটি হেফাজতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অডিট চূড়ান্তকরণে নিরপেক্ষ ও সৎ সদস্যসহযোগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং অনাদায়ী অর্থ আদায় করবেন।

৫. মেয়াদভিত্তিক কমিটি: একটি নির্বাচিত কমিটির নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকা জরুরী। সেটা তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী হতে পারে। এতে প্রত্যেক কমিটির উপর কর্ম-সম্পাদনের একটি মেয়াদভিত্তিক সীমা ও চাপ থাকবে; থাকবে মেয়াদ শেষে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা। প্রতি মেয়াদ শেষে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন বা পুনর্গঠন হলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবার সুযোগ পাবে। এতে হেফাজতের তৎপরতা শানিত হবে।


(চলবে)