মূল পাতা আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইটের ছবিতে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক 03 December, 2023 10:04 AM
নতুন কিছু স্যাটেলাইটের ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে, ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি শুরুর আগে, উত্তর গাজাজুড়ে ব্যাপক পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। স্যাটেলাইটের ছবিগুলো গত ২৩শে নভেম্বরের, টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চলার পর যখন যুদ্ধবিরতি হয় তার ঠিক আগের। আরেকটি আলাদা স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষণে পুরো গাজার ধ্বংসযজ্ঞের বিভিন্ন চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ড্রোন ফুটেজ ও ভেরিফায়েড ভিডিওতে আরও দেখা যায় বিভিন্ন ভবন ও কোথাও পুরো পাড়া একেবারে মাটিতে মিশে গিয়েছে। যদিও ইসরায়েলের সর্বাত্মক স্থল অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল গাজার উত্তরাঞ্চল, যা ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন বহন করছে, কিন্তু আসলে পুরো উপত্যকা জুড়েই মারাত্মক ধ্বংসের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
ইসরায়েল বলছে, গাজার উত্তর এলাকা, যা মূলত গাজার মূল শহর অঞ্চল, এটি আসলে “হামাসের কেন্দ্রবিন্দু” ছিল, যারা ইসরায়েলে ৭ই অক্টোবর ভয়ংকর হামলা চালিয়েছিল। ইসরায়েলের দাবি, তারা বোমা হামলার মাধ্যমে সফলভাবে হামাস নেতা ও যোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পেরেছে এবং তাদের অভিযোগ এই গোষ্ঠী বেসামরিক নাগরিকদের ভেতরে ঢুকে মিশে গিয়েছিল।
স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, পুরো গাজাজুড়ে অন্তত ৯৮ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং উপরের মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে এর বেশিরভাগই উত্তরে অবস্থিত। তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করেছেন সিটি ইউনিভার্সিটির নিউ ইয়র্ক গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের কোরি স্কার এবং ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যামন ফন ডেন হোয়েক। এক্ষেত্রে দুটো আলাদা ছবির মধ্যে তুলনা করা, হামলার ফলে ভবনগুলোর কাঠামো বা উচ্চতার পরিবর্তনকে এর ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। সেখানে ধ্বংস হওয়া বিভিন্ন এলাকার স্যাটেলাইটের ছবি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
উত্তর – পূর্ব এলাকায় প্রথম বিমান হামলা হয়
ইসরায়েলে ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকের শহর বেইত লাহিয়া এবং বেইত হানুন প্রথম বিমান হামলার শিকার হয়। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স-আইডিএফ বলছে এই এলাকায় হামাস আত্মগোপনে ছিল। বালু আর জলপাই বাগানে ঢাকা বেইত লাহিয়ার অংশ যা ইসরায়েলের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, একেবারে সমান হয়ে গিয়েছে এখন। স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা যায় শহরটির উত্তর-পূর্ব দিকের একটা অঞ্চলে অনেকগুলো ভবন এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত। বুলডোজার দিয়ে সেসব জায়গায় ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে রাস্তা বের করা হয়েছে এবং ইসরায়েল সেনারা জায়গা পরিষ্কার করে মাঠজুড়ে যুদ্ধে আত্মরক্ষার অবস্থান তৈরি করেছে।
আইডিএফ একই সাথে পাশের আরেকটা ছোট শহর বেইত হানুনে হামলা করেছে, যা সীমান্ত থেকে এক মাইলের মধ্যেই অবস্থিত। আইডিএফ বলছে তারা সেখানে প্রথম দিনের বিমান হামলায় ১২০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। নিচের ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন, উঁচু বহুতল ভবন এবং একটা মসজিদ ১৪ই অক্টোবর থেকে ২২শে নভেম্বরের মধ্যে ধীরে ধীরে কীভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
পাঁচ তারকা হোটেল ও তার পাশের এলাকাও ধ্বংস হয়েছে
গাজায় টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে বিমান হামলার পর, ইসরায়েল স্থল অভিযান শুরু করে – যেসব জায়গায় প্রচুর বোমা পড়েছে তার মধ্যে দিয়ে ট্যাংক ও বুলডোজার দিয়ে এগিয়ে যায় তারা। আইডিএফ উপকূল ধরে গাজার শাতি শরণার্থী শিবির লক্ষ্য করে দক্ষিণের দিকে যেতে থাকে। নিচের ছবিতে পরিষ্কার বোঝা যায় একসময় আবাসিক এলাকা থাকা এই অঞ্চল এখন ধ্বংসাবশেষ মাত্র। সমুদ্রের দিকে থাকা কিছু ভবন যার মধ্যে আছে গাজার ফাইভ স্টার হোটেল, দ্য আল-মাশতাল, বাজার, রেস্টুরেন্ট এসবই আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দক্ষিণ গাজার ধ্বংসাবশেষ
বিমান হামলা শুরুর সপ্তাহখানেক পর আইডিএফ ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তার জন্য সতর্ক করে দিয়ে বলে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে ওয়াদি গাজা বলে পরিচিত নদীর দিকে যেতে বলে। এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও এবং যখন হাজার হাজার মানুষ গাজা শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল তখনও দক্ষিণ গাজা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়।
শরণার্থী শিবিরেও ভবন ধ্বংস হয়েছে
গাজার কেন্দ্রে অবস্থিত নুসেইরাত শরণার্থী শিবির যুদ্ধবিরতির আগ দিয়ে কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে এই শিবিরে অন্তত ৮৫ হাজার মানুষ থাকতো। গত কয়েকদিন হল অনলাইনে শেয়ার হওয়া একটা ভিডিও ভেরিফাই করেছে, যেখানে দেখা যায় মানুষকে ধ্বসে পড়া ভবনের নিচ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে। এই বিষয়ে আইডিএফের কাছে মন্তব্য চেয়েছে।
১০ লাখ লোককে দক্ষিণে সরে যাবার নির্দেশ
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে হাজার হাজার লোক তাবু অথবা বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভেতরেই বসবাস করছে। যদিও এইদিকে উত্তরের মতো ততোটা ভয়াবহ ধ্বংস হয়নি, তবে কোরি স্কার ও জ্যামন ফন ডেন হোয়েকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শহরের অন্তত ১৫ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিমান হামলায় বিরতি কিছু মানুষকে বাজারে বের হতে সাহস দিচ্ছে। নিচের ছবিতে গ্র্যান্ড মসজিদের সামনে বাজার ও পাশে ধ্বংস হওয়া ভবন দেখা যাচ্ছে।
ইসরায়েল এক দীর্ঘ যুদ্ধে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে
ইসরায়েলি সেনারা গাজার মানুষদের যেমন উত্তর থেকে সরিয়ে দিয়েছে, তেমনি পুরো উপত্যকাকে পশ্চিমের দিকে আলাদা করে ফেলেছে, যাতে দক্ষিণ থেকে গাজা শহরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। গাজা শহরের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে নেয়া এই ছবিতে আমরা দেখতে পাই একসময় মানুষে পরিপূর্ণ এই আবাসিক এলাকা আইডিএফ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুরোপুরি ফাঁকা করে দিয়েছে এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগর তীর অভিমুখে বুলডোজার দিয়ে একটা রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। একই সাথে ট্যাঙ্কসহ কয়েক ডজন সামরিক বাহন ও তার পেছনে যোদ্ধাদের দেখা যাচ্ছে।
স্যাটেলাইটের ছবিতে আরও দেখা যায় গাজার আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটা খোলা চারকোণা জায়গায় মাটিতে গাড়ি চলার রাস্তা বানিয়ে ইসরায়েলের প্রতীক ‘স্টার অফ ডেভিড’ তুলে ধরা হয়েছে।
যুদ্ধের আগে অনলাইনে পাওয়া এখানকার ছবি বলছে ঐ জায়গায় বাচ্চারা খেলছে এবং সম্ভবত এটা একটা পার্ক ছিল। কিন্তু আইডিএফের মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগিরি বলছেন এই জায়গা হামাস তাদের প্যারেড চত্বর হিসেবে ব্যবহার করতো। জায়গাটি এখন আইডিএফের গোলানি ব্রিগেডের দখলে।
সামাজিক মাধ্যম এক্সে করা এক পোস্টে মি. হাগিরি জানান, যুদ্ধ শুরুর পর যে সমস্ত ইসরায়েলি সেনারা মারা গিয়েছে তাদের স্মরণে এক অনুষ্ঠানে ইসরায়েল ও ইহুদীদের প্রতীক ‘স্টার অফ ডেভিড’ করা হয় সামরিক যান ব্যবহার করে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা