রহমত নিউজ 17 August, 2023 12:19 PM
বাংলাদেশে কার্যকর হওয়া নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী এখন থেকে জমি বিক্রি করে পাওয়া লাভ বা মুনাফা করদাতার আয়ের সঙ্গে যোগ হবে এবং করদাতা ব্যক্তিকে এ আয়ের ওপর কর দিতে হবে। জমি বিক্রি থেকে হওয়া মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে, যা গেইন ট্যাক্স হিসেবে পরিচিত। একই সঙ্গে কেউ যদি কাউকে জমি হেবা বা দান করে দেয়, বা অন্যের নামে রেজিস্ট্রি করে পাঁচ বছরের মধ্যে আবার নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে সেই জমি বিক্রি করে, তাহলে তাকেও ওই মুনাফার ওপর কর দিতে হবে। যদিও এই কর নির্ধারণের সময় বিক্রেতা জমি ক্রয়ের সময় উৎসে যে কর দিয়েছিলেন সে অংশটুকু বাদ দিয়ে হিসেব করা হবে। এতদিন ওই উৎস-করকেই বিক্রেতার জন্য চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
আয়কর বিশেষজ্ঞ ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট সাব্বির আহমেদ বলছেন, বিক্রেতার জন্য আগেও কর নির্ধারিত ছিলো, কিন্তু জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় বিক্রেতার ওই কর এতোদিন ক্রেতা পরিশোধ করে আসছিলো। এখন ক্রেতাকে নির্ধারিত কর যেমন দিতে হবে, তেমনি বিক্রেতাকেও জমি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত লাভের ওপর কর দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ একজন ব্যক্তি যদি এক কোটি টাকা দিয়ে কোনো জমি ক্রয় করেন এবং এখন বিক্রি করেন দুই কোটি টাকায়, তাহলে গেইন ট্যাক্স অনুযায়ী তাকে এক কোটি টাকা লাভের হিসেবে কর দিতে হবে পনের লাখ টাকা। কিন্তু তিনি ক্রয়ের সময় রেজিস্ট্রেশনের জন্য উৎসে কর দিয়েছেন দশ লাখ টাকা। ফলে কার্যত এখন তাকে বাকী পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে।
আরেকজন আয়কর আইন বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলছেন, ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আগে থেকেই আছে, তবে আগে এটাই ছিলো চূড়ান্ত কর। এখন নতুন আইনে এটি হয়ে গেছে ন্যূনতম কর। তবে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বা উপহার হিসেবে পাওয়া জমি বিক্রি করতে গেলে লাভ বা মুনাফা কিভাবে নির্ধারিত হবে তা নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে আয়কর আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। বিশেষ করে অনেক বছর আগে (যেমন ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলে) কেনা জমি বংশ পরম্পরায় কেউ পেয়ে এখন বিক্রি করলে, তার ক্ষেত্রে মুনাফা কীভাবে নির্ধারিত হবে তা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।
আয়কর আইনজীবী সাইফুল আলম বলছেন জমিটা যে সময় রেজিস্ট্রি করা হয়েছে সে সময়ের সরকার নির্ধারিত বাজার মূল্য ধরে এখনকার বিক্রি মূল্যের সাথে পার্থক্য করলেই লাভের পরিমাণ বেরিয়ে আসবে।
তবে সাব্বির আহমেদ বলছেন, এ বিষয়টি নিয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা না থাকায় অস্পষ্টতা রয়েছে, যা কর্তৃপক্ষের পরিষ্কার করা উচিত। জমির দলিলে একটা মূল্য থাকবে সেটা ব্রিটিশ আমল হোক আর পাকিস্তান আমল হোক। সুতরাং সেই সময়ের ক্রয়মূল্য আর এখনকার বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যও বের করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হলো দাদা জমিটা যেই দামে কিনেছেন, সেটা নাতি বা তার সন্তান বিক্রি করতে গেলে তাদের জন্যও সেটা ক্রয়মূল্য হিসেবে প্রযোজ্য হবে কি না- এসব প্রশ্নের সদুত্তর দরকার।
জানা গেছে, আয়কর আইনে চলতি বছর কিছু পরিবর্তন আনার কারণে পুরনো আইনটির কিছু ধারা বাতিল হয়ে গেছে। নতুন আইন অনুসারে জমি বিক্রির লাভ মুলধনি আয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এ ধরনের আয়কে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, একটি হলো জমি ক্রয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে বিক্রি করলে ব্যক্তির আয় অনুযায়ী নির্ধারিত হারে কর দিতে হবে। আর অন্যটি হলো ক্রয়ের পাঁচ বছর পর বিক্রি করলে ১৫ শতাংশ হারে গেইন ট্যাক্স প্রদান করতে হবে। আগের আইনে ছয়টি খাতে উৎস-করকেই চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এর মধ্যে ছিলো জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া অর্থ, সঞ্চয়পত্রের সুদ, রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তা, এমপিওভুক্ত স্কুলের এফডিআর, জমি বিক্রয় ও জমি ডেভেলপারদের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী সাইনিং মানি। এখন নতুন আইন অনুসারে এসব খাতের আয় মূলধনি আয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এই আয়ের জন্যে কর দিতে হবে। আগে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ক্রেতা যে উৎসে কর দিতো তার পরিমাণ ছিলো আট শতাংশ। কিন্তু এখন বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রেতাকে ১৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স দেয়ার সময় আগের দেওয়া কর বাদ দিয়ে বাকী অর্থ দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে জমির মূল্য নির্ধারণ, দলিলে দেখানো দাম ও প্রকৃত বাজার মূল্য -এসব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কর এড়ানোর জন্য শহর এলাকাগুলোতে, যেখানে জমির বাজার মূল্য সরকার নির্ধারিত মৌজা মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি, সেসব এলাকায় জমির দলিলেও মূল্য কম প্রদর্শন করার প্রবণতা রয়েছে। আবার অনেক এলাকায় মৌজা ভ্যালু বেশি হওয়ায় মানুষকে অনেক বেশি কর দিতে হয়।
স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলছেন, এ ধরনের সংকট এড়িয়ে যথাযথ কর আদায়ের জন্য মৌজা ভ্যালুকে সময়োপযোগী করা উচিত। প্রতিটি স্থানভিত্তিক মৌজা ভ্যালু নির্ধারণ করতে হবে এবং এটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে সময়োপযোগী করতে হবে। একই সাথে প্রপার্টি সংক্রান্ত করগুলোকে যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা দরকার, যাতে মানুষ প্রকৃত দামে জমি ক্রয়-বিক্রয়ে উৎসাহিত হয়। এটি হলে দুর্নীতিও কমবে, আবার সরকারও প্রাপ্য কর পাবে।