রহমত নিউজ ডেস্ক 24 July, 2023 01:11 PM
দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে প্রায় শতাধিক বৈঠক করে শনিবার মধ্যরাতে ঢাকা ছেড়ে গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা, সেটি পর্যালোচনা করে দেখতে বাংলাদেশে এসেছিল এই দলটি। এখন তারা তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল একটি প্রতিবেদন আকারে জমা দেবে ইইউর পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের কাছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন সংক্রান্ত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় সদসের ওই প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে এসেছিল নয়ই জুলাই। বাংলাদেশে দুই সপ্তাহের সফরকালে কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছে। বাংলাদেশে যাদের সঙ্গে এই প্রতিনিধিদলের আলোচনা হয়েছে, তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বোঝা যাচ্ছে যে, এই দলটি জানার চেষ্টা করেছে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হতে পারে, সেই সময়ের পরিবেশ নিয়ে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করেছেন। সেই সময় নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের ভূমিকা কেমন হবে আর রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে অবস্থান কি হতে পারে, - সেটাও জানার চেষ্টা করেছেন তারা। ইইউর এই প্রতিনিধিদল বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয়ে তাদের মতামত নিয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করেছে।
ইইউ প্রতিনিধিদল কোন বিষয়গুলোকে আলোচনায় প্রাধান্য দিয়েছে?
বাংলাদেশের যেসব পক্ষ বা সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে ইইউ প্রতিনিধিদলের আলোচনা হয়েছে, সেখানে মূলত গুরুত্ব পেয়েছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, কূটনীতিক, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতির মতো বিষয়গুলো। যদিও এই সফরের আলোচনার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে সরাসরি কিছু জানানো হয়নি। তবে তারা যাদের সঙ্গে বৈঠক বা আলোচনা করেছেন, তারা পরবর্তীতে গণমাধ্যমের কাছে আলাপের বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। তা থেকে তাদের আগ্রহের বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দুদফা বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল। সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, কমিশনের সক্ষমতা, আইন-কানুন, নির্বাচনের সময় সহিংসতার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে তারা। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সব দলের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা আছে কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা কি হতে পারে, সেটা বোঝার চেষ্টা করেছে এই প্রতিনিধিদল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একই দিনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টিসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রতিনিধিদল। সেসব বৈঠকের পর দলগুলোর নেতারা আলোচনার বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী পরবর্তীতে সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে যে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন আদৌ জনগণের ভোটের মাধ্যমে সম্ভব হবে কিনা।... আমাদের পক্ষ থেকে তাদের বলেছি, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, সম্ভব না। কারণ এদের অধীনে নির্বাচন হবে না।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার একটি হোটেলে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তারা দেখতে চান, আমরাও বলেছি, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরও কমিটমেন্ট। বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব ও আইন ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তারা এখানে নির্বাচন দেখতে চায়। তারা নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে আশ্বস্ত হয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। নো সংলাপ এবং নো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পার্লামেন্টের বিলুপ্তি, সরকারের পদত্যাগ, এসব কোন বিষয়েই আলোচনা হয়নি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়েও কোন আলোচনা হয়নি।
আলোচনার সময় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেছে জাতীয় পার্টি। তবে ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি বলে দলটির নেতারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। ইইউ দলের সঙ্গে আলোচনার পর জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, নির্বাচন কীভাবে স্বচ্ছ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা যায়, সেই ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, আমরা নির্বাচনে যেতে চাই, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে নির্বাচনে যাবো। আগামী নির্বাচনে ডেলিগেটস পাঠানোর ব্যাপারে তারা আমাদের মতামত চেয়েছিল। আমরা বলেছি, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয় তাহলে স্বাগতম। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ডেলিগেটস আসা ঠিক হবে না।
দুই সপ্তাহের সফরকালে গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সাথে বৈঠকের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠক শেষে ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে যে, গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সবারই উদ্বেগ আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যম ভূমিকা রাখবে বলে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। আর নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির বলেছেন, তাদের অনুরোধ জানিয়েছি, যাতে ফিরে গিয়ে এমন রিপোর্ট না দেয়, আমরা সেই প্রত্যাশার কথা জানিয়েছি।
নাগরিক সমাজের মধ্যে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস), মানবাধিকার সংস্থা অধিকার, সিপিডি, সুজনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইইউ দলের সদস্যরা। বৈঠক শেষে ড. মাহফুজ কবির সাংবাদিকদের বলেন, ইইউ প্রতিনিধিদল বর্তমান নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে। আমি তাদের বলেছি, এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্তি ও সহিংসতা মুক্ত। নির্বাচনের আগে ইইউর উচিত একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানো। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে।
আদিলুর রহমান খান বলেন, মানবাধিকার কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে, মানবাধিকার সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটাই আমি প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছি।
অন্যদিকে বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দেশের অবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক কিনা, তারা সেটি জানতে চেয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছি, নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা সঠিক হতে হবে।
দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও ইইউ দল আলোচনা করেছে। নির্বাচনের সময় তারা কি ধরনের সমস্যায় পড়েন, সেটা জানতে চাওয়া হয়েছে তাদের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা কীভাবে শান্তি বজায় রাখবে।
ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের গুরুত্ব কতটা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা, তা নির্ভর করবে এই প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদনের ওপরে। তাদের সুপারিশের ওপর নির্ভর করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। পর্যবেক্ষক না পাঠালে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইইউর কাছে প্রশ্ন থেকে যাবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, এখানে দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। তারা ভালো একটা রিপোর্ট দিতে পারে, আবার খারাপ রিপোর্টও দিতে পারে। যদি তারা ভালো রিপোর্ট দেয় যে, এখানে সরকার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে সবাই সন্তুষ্ট, ভালো নির্বাচন হবে, কোন সমস্যা নেই, আমরা একটা পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারি। কিন্তু এরকম সম্ভাবনা বেশ কম, কারণ তারা তো সব পক্ষের সঙ্গেই কথা বলেছে। বিরোধীদের অনেকেই বলেছে যে, তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেই না। আমরা জানি, সরকার এবং বিরোধী- দুই পক্ষই তাদের কাছে একটা অনড় অবস্থান জানিয়েছে। ধরা যাক, তারা খারাপ রিপোর্ট দিলো যে, এখানে সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে, শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই, যদি না সরকার অবস্থান পরিবর্তন করে। যদি সেটাই হয়, তাহলে তো পর্যবেক্ষক পাঠানোর কোন মানে হবে না। তখন সেটা দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেটার ফলাফল কি হতে পারে? এর ফলে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া না পাওয়ার ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি কিছুদিন আগে বলেছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে সহায়ক হবে। কারণ এই সুবিধার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন ৩২ অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক, পরিবেশগত, সামাজিক, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। কিন্তু সরকারি বা বিরোধী দল- তাদের দৃষ্টি ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। ২০২৬ সালে কী হবে না হবে, সেটা কেউ বিবেচনায় নিচ্ছে না। আবার পর্যবেক্ষক না পাঠালে হয়তো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু তার প্রেক্ষিতে কি কোন পরিবর্তন আসবে? ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও তো প্রশ্ন আছে, সে কারণে কি সরকারের কোন সমস্যা হয়েছে?
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে একাধিকবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। মে মাসে ঘোষণা করা বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সেদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় - তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সরকার হয়তো চাইবে না, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ নতুন কোন চাপ বা প্রশ্নের মুখে পড়ুক। সরকার হয়তো চাপের মুখে এমন একটা ব্যবস্থা চাইতে পারে যে, অন্তত আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন হোক,এটা হয়তো আশা করা যেতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাবে না, তিনি বলছেন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা