| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক ইউরোপ ‘এখানে শান্তিপূর্ণ পথে কাজ হয় না তাই আমরা সহিংস হচ্ছি’


‘এখানে শান্তিপূর্ণ পথে কাজ হয় না তাই আমরা সহিংস হচ্ছি’


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     09 July, 2023     09:24 AM    


নান্তেরের রাস্তায় যেদিকেই তাকানো যায়, দেখা যাচ্ছে গত কয়েকদিনের দাঙ্গার চিহ্ন। প্যারিসের পশ্চিম দিকের এই শহরতলীটিতে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক পোড়ানো গাড়ি - সেগুলোর শুধু ধাতব খোলসটা আছে, ভেতরের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পথে পথে পড়ে আছে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া লোহালক্কড়, গলে

যাওয়া দরজার হাতল, ভাঙা কাচ। এই এলাকাটিতেই নাহেলের বাড়ি - ১৭ বছরের যে কিশোর গত সপ্তাহে পুলিশের গুলিতে নিহত হবার পর এই দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। এখানকার দেয়ালে দেয়ালে দেখা যাচ্ছে নাহেল হত্যার বিচার চেয়ে লাল-কালো রঙে লেখা শ্লোগান - তরুণরা এভাবেই দেয়াল লিখন দিয়ে প্রকাশ করেছে তাদের ক্রোধ।

এখানকার কিছু বাসিন্দার সাথে কথা বলেছেন বিবিসির সংবাদদাতা মুরাদ শিশানি। এখানকার বাসিন্দারা স্পষ্টতই পুলিশ বা সংবাদমাধ্যম - কাউকেই বিশ্বাস করে না। একটি তরুণ চিৎকার করে সাংবাদিকদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বললো। অন্য আরেকজন সাংবাদিকদের বললেন, আমরা যেন সাবধানে থাকি কারণ আমাদের সাথে থাকা ক্যামেরাগুলোর জন্য আমরাই আক্রান্ত হতে পারি। প্যারিসের বিত্তবান বাণিজ্যিক এলাকা লা ডিফেন্স -প্রায় এখানকার লাগোয়া। কিন্তু নান্তেরেতে যারা থাকে তাদের জন্য সেটা প্রায় অন্য এক জগৎ। নাহেলের হত্যাকাণ্ড ফরাসী সমাজে এক গভীর বিভক্তিকে প্রকাশ্য করে দিয়েছে। এখানকার বাতাসেই যেন সেই চাপা উত্তেজনা অনুভব করা যায়।

ওদের মত আমরাও মানুষ
একজন - বয়স তার বিশের কোঠায় - খানিকটা মন খুলে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে শুরু করলো। কিন্তু তখনই আবার এগিয়ে এলো অপেক্ষাকৃত বয়স্ক আরেকজন লোক। মনে হলো, সে তরুণটিকে বলছে আমাদের সাথে কথা না বলতে। কিন্তু তরুণটি কথা বলতেই থাকলো। তবে এবার সে সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিলো যেন তার নাম উল্লেখ করা না হয়। ফলে তার পরিচয় দেয়া হচ্ছে আবদুল্লাহ নামে। আবদুল্লাহ ছিল নাহেলের প্রতিবেশীদের একজন। সে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে।

তার কথা, সে সহিংসতাকে কাজে লাগাতে চায়নি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য এটাই ছিল একমাত্র পন্থা। ওরা আমাদের কথা শোনে না, আমাদের পাত্তা দেয় না। এখানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোন কাজ হয় না - তাই আমরা সহিংস পন্থার আশ্রয় নিই। আমরা ওদের জানাতে চাই যে আমরা ক্রুদ্ধ। আমরা ওদের বুঝিয়ে দিতে চাই যে যথেষ্ট হয়েছে... নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা থামাতে হবে, আরব ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ বন্ধ করতে হবে। এসব আর মেনে নেয়া হবে না। ওদের মতই আমরাও মানুষ।

বহিষ্কৃত ও প্রত্যাখ্যাত
নাহেলের পরিবার যেখানকার বাসিন্দা সে জায়গাটির নাম পাবলো পিকাসো এস্টেট। এখানে অনেকগুলো বহুতল ভবনে বাস করে প্রায় ১২ হাজার মানুষ। তাদের অধিকাংশই আরব ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৭০এর দশকে। সে সময় ফ্রান্সে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং অভিবাসী সম্প্রদায়ের লোকদের থাকতে দেবার জন্য বাড়ি তৈরি করা দরকার হয়ে পড়েছিল। বহুতল ভবনগুলোর একটিতে বাস করেন ফাতিহা আবদুনি। তিনি একজন সামাজিক অধিকারকর্মী। ফাতিহার বয়স ৫২ এবং তিনি ২০ বছরেরও বেশি আগে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সে এসেছিলেন। তার ছেলে ডিজলেক্সিয়া আক্রান্ত বলে স্কুলের শিক্ষকরা তাকে বলে দিয়েছিলেন, ওকে দিয়ে কিছু হবে না। এর পর থেকেই ফাতিহা সামাজিক অধিকারকর্মী হবার ব্রত নেন। তিনি বলছেন, আমরা কোন বাড়িঘরে আগুন লাগাতে চাইনি বা কোন কিছু ধ্বংস করতে চাইনি। কিন্তু আমরা এখন প্রচণ্ড চাপ ও নিপীড়নের সম্মুখীন এবং আসলেই ক্রুদ্ধ। নাহেলের মৃত্যু ছিল সেই স্ফুলিঙ্গের মত - যা আমাদের ভেতরকার ক্রোধে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এই ক্রোধ তৈরি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে - যার কারণ তাদেরকে বর্ণবাদী দৃষ্টিতে দেখা এবং কাজের সুযোগের অভাব।

পাবলো পিকাসো এস্টেটের বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, এখানকার মানুষদের মধ্যে কাজ করছে একঘরে হয়ে থাকা এবং ব্যাপকতর সমাজের দিকে থেকে আসা প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি। এ কারণে কিছু লোক অপরাধ এবং মাদক বিক্রির সাথে জড়িয়ে পড়েছে।

দেখা গেল, একজন মুখোশধারী ব্যক্তি একটি বহুতল ভবনে ঢোকার পথ পাহারা দিচ্ছে। অন্য আরেকজন মোটরবাইকে করে টহল দিচ্ছে, কখন পুলিশ আসে তার ওপর নজর রাখছে। এখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনের একটি কেন্দ্র হলো স্থানীয় কফির দোকানগুলো। এগুলোতে বসে বাসিন্দারা খোলাখুলি আলোচনা করেন যে এদেশে অভিবাসীদের জীবন কেমন। প্যারিসের উত্তর-পূর্বের উপশহরগুলোর একটি হচ্ছে ওবারভিলিয়ার্স । গত কয়েকদিনে এখানেও দাঙ্গা হয়েছে। এখানে একটি কফিশপে কথা হয় স্থানীয় দুজন বাসিন্দার সাথে। আবদুর রাজ্জাক ও ফাদি সম্প্রতি অবৈধ পথে ফ্রান্সে এসেছেন। তারা ফরাসী নাগরিক নন, তবে তাদের অভিযোগগুলো প্রায় একই রকম।

আবদুর রাজ্জাক বললেন, এখানে আপনার অধিকার পদদলিত হচ্ছে, কারণ আপনি আরব। সবখানে বর্ণবাদ। ফরাসীরা আমাদের গ্রহণ করতে চায় না। আমরা জানি না কেন। আমরা তো এখানে শুধু কাজ করতে এসেছি। তিনি পুলিশের খারাপ আচরণের শিকার হয়েছেন। কখনো কখনো পুলিশ আমাদেরকে কোন কারণ ছাড়াই আক্রমণ করে। আমাদেরকে তারা আটক করে, অপমান করে, আমরা যখন তাদের সাথে আলজেরীয় টানে ফরাসী বলতে চেষ্টা করি, তখন আমরা কী বলছি তা বোঝার চেষ্টাও তারো করে না।

ফাদি বলছিলেন, এমনকি যে আরবরা এখানেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং ফরাসী পাসপোর্টধারী, তারা দুই আত্মপরিচয়ের দোটানার মধ্যে আছে। তারা আরবও নয়, ফরাসীও নয় । তারা আছে মাঝখানে, তাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে গেছে। এসব অভিযোগ পুলিশের কাছে তোলা হলে তারা জবাব দেয়, "ফ্রান্সের জাতীয় পুলিশ বাহিনী মূল্যবোধের মধ্যে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের স্থান নেই।" তারা আমাদেরকে সাবধান করলো যে এর বিপরীত যে দাবি করা হচ্ছে তা বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সহায়ক হবে না। পুলিশ বলছে, এ বাহিনীর ভেতরে কেউ এসব মূল্যবোধের বিরোধী কোন কাজ করলে তারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং "বিপথগামীদের" কঠোর শাস্তি হয়। মার্সেই শহর - যেখানে এবার দাঙ্গা গুরুতর আকার নিয়েছিল - সেখানকার অন্যতম কুখ্যাত এলাকা হচ্ছে ফ্রেইজ-ভালঁ। বিকেলবেলা এখানে প্রকাশ্যেই মাদক বেচাকেনা চলতে দেখা যায়। এখানেই কয়েকজনের সাথে কথা বলেছেন বিবিসির জেনি হিল।

একজনের নাম আমিন - একজন সমাজকর্মী। তার বয়স যখন ১৭ তখন তার মাদকব্যবসায়ী ভাই খুন হয়। তার কথায়, এখানে মাদক চোরাচালান অনেক তরুণের জন্য লোভনীয় বিকল্প। কারণ এখানে আর কোন বিকল্প নেই। কোন কোম্পানি এখানে এসে বলবে না যে তোমাকে আমরা ন্যূনতম মজুরির চেয়ে বেশি বেতন দেবো। এখানে লোকজন সুপারমার্কেট ক্যাশিয়ার, ক্লিনার আর সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিই করে। আমাদের বিচারপতি, আইনজীবী বা অ্যকাউন্ট্যান্ট হবার কোন উপায় নেই।এখানে তাদের অবস্থা একই রকম থাকবে - কিছুই বদলাবে না। আমি তরুণদের ক্রোধ বুঝতে পারি। আমি সহিংসতা সমর্থন করছি না কিন্তু আমি এর কারণ বুঝতে পারছি।

এখানকার আরেক বাসিন্দা ম্যাডো - একজন মধ্যবয়সী মহিলা। তিনি বলছেন, এখানে থাকাটা অনেকটা আবর্জনার বাক্সে বসবাস করার মতো। জায়গাটা নিরাপদ নয়। লোকে লিফট আর সিঁড়িতে মলত্যাগ করে। রাজনীতিবিদদের চোখে আমরা কিছুই নই। আসলেই কিচ্ছু নই।

মুরাদ নামে আরেকজন বলছিলেন, এ জায়গাটার সবখানে ইঁদুরে ভর্তি। আমাদের সবার অধিকার সমান নয়।রাজনীতিবিদরা মিডিয়াতে বলে, আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নই। কিন্তু বাস্তবে এর কোন সত্যতা নেই।

দাঙ্গার কয়েকদিন আগেই মার্সেই ঘুরে গেছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ। তিনি এ এলাকায় থানা, স্কুল, কারাগার ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন আমিন। তিনি বলেন, ম্যাক্রঁ এখানে আসেন নানারকম ঘোষণা দিতে, আমাদের কথা শুনতে নয়।