রহমত নিউজ ডেস্ক 04 December, 2022 04:37 PM
চলতি বছরের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে ৪৬৩ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এত নিহত ৫৫৪ জন এবং আহত ৭৪৭ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৭৮, শিশু ৭১। ১৯৪ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২২৯ জন, যা মোট নিহতের ৪১.৩৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১.৯০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১২৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২২.২০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৯ জন, অর্থাৎ ১৪.২৫ শতাংশ। এই সময়ে ৩টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত, ৭ জন আহত ও ২ জন নিখোঁজ রয়েছে। ৮টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়েছে।
আজ (৪ ডিসেম্বর) রবিবার রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র : দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২২৯ জন (৪১.৩৩%), বাস যাত্রী ২৮ জন (৫.০৫%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-ড্রামট্রাক-মিক্সার মেশিন গাড়ি আরোহী ৩৪ জন (৬.১৩%), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার যাত্রী ৫ জন (০.৯%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ৯৩ জন (১৬.৭৮%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-ঘাসকাটা মেশিন গাড়ি) ৩১ জন (৫.৫৯%) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-প্যাডেল ভ্যান আরোহী ১১ জন (১.৯৮%) নিহত হয়েছে।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরণ : রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৯২টি (৪১.৪৬%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৪৮টি (৩১.৯৬%) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৪টি (১৫.৯৮%) গ্রামীণ সড়কে, ৪৩টি (৯.২৮%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি ১.২৯% সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরণ : দুর্ঘটনাসমূহের ৮১টি (১৭.৪৯%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২০৬টি (৪৪.৪৯%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১২৬টি (২৭.২১%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৩৮টি (৮.২০%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১২টি (২.৫৯%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনসমূহ : দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-পুলিশভ্যান ২২.৯৮%, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রাম ট্রাক-ডাম্পার ট্রাক-ট্যাঙ্ক লরি-মিক্সার মেশিন গাড়ি ৫.৮১%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স ৩.৩০%, যাত্রীবাহী বাস ১২.৫৪%, মোটরসাইকেল ২৮.৬৬%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ১৬.১১%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন-(নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-টমটম-মাহিন্দ্র-পাওয়ারটিলার-ধান মাড়াইয়ের মেশিন গাড়ি-ঘাস কাটার মেশিন গাড়ি) ৭%, এবং বাই-সাইকেল-প্যাডেল রিকশা-প্যাডেল ভ্যান ৩.৫৬%।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা : দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৭৫৭ টি। (ট্রাক ১২৫, বাস ৯৫, কাভার্ডভ্যান ১৮, পিকআপ ৩০, পুলিশভ্যান ১, ট্রলি ১৫, লরি ৬, ট্রাক্টর ৮, ড্রাম ট্রাক ৭, ডাম্পার ট্রাক ৩, ট্যাঙ্কলরি ৩, মিক্সার মেশিন গাড়ি ২, মাইক্রোবাস ১০, প্রাইভেটকার ১২, অ্যাম্বুলেন্স ৩, মোটরসাইকেল ২১৭, থ্রি-হুইলার ১২২ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৫৩ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-টমটম-মাহিন্দ্র-পাওয়ারটিলার-ধান মাড়াইয়ের মেশিন গাড়ি-ঘাস কাটার মেশিন গাড়ি) বাই-সাইকেল ৭, প্যাডেল রিকশা ১৪ এবং প্যাডেল ভ্যান ৬টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ : সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৪.১০%, সকালে ৩০.০২%, দুপুরে ১৭.৪৯%, বিকালে ১৯.৪৩%, সন্ধ্যায় ১০.১৫% এবং রাতে ১৮.৭৯%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান : দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ৩০.৬৬%, প্রাণহানি ৩১.৪০%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৮.৭৯%, প্রাণহানি ১৮.৫৯%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.৯০%, প্রাণহানি ১৪.২৫%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৫০%, প্রাণহানি ৯.৩৮%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.১২%, প্রাণহানি ৬.৩১%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪.১০%, প্রাণহানি ৩.৬১%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.২০%, প্রাণহানি ৯.২০% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৬৯%, প্রাণহানি ৭.২২% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৪২টি দুর্ঘটনায় ১৭৪ জন নিহত। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৯টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ২৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ময়মনসিংহ জেলায় সবচেয়ে বেশি ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে মানিকগঞ্জ, নড়াইল, ঝালকাঠি, লালমনিরহাট ও রাঙ্গামাটি জেলায়। এই ৫টি জেলায় ১১টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ১৮ টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ২২ জন আহত হয়েছে।
নিহতদের পেশাগত পরিচয় : গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৬ জন, এনএসআই সদস্য ১ জন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১৪ জন, চিকিৎসক ২ জন, প্রকৌশলী ৩ জন, সাংবাদিক ৪ জন, আইনজীবী ৩ জন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ১ জন, বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৩ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৭ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৮ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৩৪ জন, পোশাক শ্রমিক ৯ জন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ২ জন, ইটভাটা শ্রমিক ২ জন, রং মিস্ত্রি ২ জন, রাজমিস্ত্রি ১ জন, কাঠমিস্ত্রি ২ জন, প্রবাসী ২ জন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৩ জন এবং ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী কলেজের ২ জন ছাত্রসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৮ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ : ১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০ গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ : ১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১০.“সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য : গত অক্টোবর মাসে ৪২৭ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮২ জন নিহত হয়েছিল। এই হিসাবে নভেম্বর মাসে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৮.৪৩ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ১৪.৯৩ শতাংশ। নভেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছে ১৮.৪৬ জন, অর্থাৎ ১৯ জন। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪৪৬ জন, অর্থাৎ ৮০.৫০ শতাংশ। ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপসহ পণ্যবাহী দ্রুতগতির যানবাহন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী যানবাহন চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। গণপরিবহন সহজ, সাশ্রয়ী ও উন্নত করে, যানজট কমিয়ে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা অতীব জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।