রহমত ডেস্ক 09 March, 2022 10:15 PM
অর্থপাচার মামলার পরোয়ানাভুক্ত আসামি খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে (৬৭) গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই। গ্রেফতার করে বাবরকে ফরিদপুরে আনার পর গতকাল মঙ্গলবার (৮ মার্চ) দুপুরে তাকে আদালতে তোলা হয়। আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান। সোমবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে রাজধানীর বাড্ডা থানা পুলিশের সহায়তায় বসুন্ধরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা পুলিশ। মঙ্গলবার (৮ মার্চ) বেলা আড়াইটায় ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। সেখানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) জামাল পাশা। জামাল পাশা জানান, নিজের ও ভাইয়ের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন বাবর। জানা গেছে, একেবারে অপরিচিত একজন মানুষ ছিলেন বাবর। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুর সদর আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরে একক আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে তিনি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অবশ্য উপজেলা নির্বাচনে ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে ফলাফল পাল্টানোর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
বাবরের যত কর্মকাণ্ড : স্থানীয় বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, খন্দকার মোহতেসাম হোসেন বাবর আগে বিএনপি ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। ২০০৮ সালে তার ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনেও বাবর তার ভাইয়ের পক্ষে কাজ করেননি। পরে তার ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রী হন। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ‘ছায়া চরিত্র’ হিসেবে আবির্ভূত হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদনা ও নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। একইসঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগেও তার প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। ওই সময় তার এসব কর্মকাণ্ডের সহযোগী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক মোকাররম মিয়া, মন্ত্রীর তৎকালীন এপিএস সত্যজিৎ মুখার্জি এবং বাবরের ঘনিষ্ঠজন বিল্লাল হোসেন।
সাধারণ থেকে হয়ে ওঠেন ক্ষমতাধর : লোকজনের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের দিকেও বাবরের মূল ব্যবসা ছিল মুরগি লালন-পালন করা এবং ডিম বিক্রি করা। এ জন্য তিনি ফরিদপুরে ‘মুরগি বাবর’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি একটি মোটরসাইকেলে করে তখন চলাফেরা করতেন। ভাইয়ের দাপটে বাবর রাতারাতি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হতে শুরু করেন। পাল্টে যেতে থাকে চলন-বলন।
বাবরের হুকুমে বণ্টন হতো দরপত্র : জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ পাসপোর্ট অফিস, সড়ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের টেন্ডার বাবরের নির্দেশ ছাড়া কেউ পেতেন না। তিনি ফরিদপুরে 'মিস্টার ১৫ শতাংশ' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কোনো কাজ করতে গেলে তাকে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো। পাসপোর্ট অফিস থেকে তিনি নিয়মিত টাকা নিতেন।
বিদেশেও গড়ে তোলেন বিত্তবৈভব : রাতারাতি প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়া বাবর মালয়েশিয়ায় বাড়ি কেনেন এবং সেখানে তার সন্তানদের আবাসনের ব্যবস্থা করে দেন। ফরিদপুর শহরের হাড়োকান্দি এলাকায় তিনি বিদেশি মডেলের একটি বিশাল বাড়ি করেছেন। জনশ্রুতি আছে, এই বাড়ি করতে তার কমপক্ষে ১৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তিনি গরুর ফার্ম করেছেন, মাছের ফার্মও করেছেন। অন্তত ৫০০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন ১০-১২ বছরে। ২০১১ সালে ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সুবল চন্দ্র সাহা। দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে তাকে সমর্থন দিয়ে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে সার্বিক ভূমিকা পালন করেন বাবর। ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধির পাশাপাশি ২০১৪ সালে তিনি ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন কেন্দ্রীয় যুবদলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ফরিদপুর বিভাগ) মাহাবুবুল হাসান পিংকু।
ক্ষমতার প্রভাবে জেলা কমিটিতে : উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আধিপত্য বিস্তারের মাত্রা বাড়াতে শুরু করেন বাবর। ২০১৬ সালে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বাবর। পরে তাকে ওই কমিটিতে দেওয়া হয় সহসভাপতি পদ। ২০১৬ সালের ওই সম্মেলনে সৈয়দ মাসুদ হোসেনকে করা হয় সাধারণ সম্পাদক। মাসুদ হোসেনের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি সুনজরে দেখেননি বাবর। সৈয়দ মাসুদকে ক্ষমতাহীন করে সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার মাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের কান্ডারি হয়ে ওঠেন বাবর। আওয়ামী লীগের রাজনীতি পরিচালনা করার নামে নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রাখা, হামলা-মামলা দিয়ে তাদের পদাবনত করে রাখার কাজও করেন বাবর। পাশাপাশি নিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে দল চালিয়েছেন তিনি। যাদের অনেকের দলে পদ ছিল না। সৈয়দ মাসুদ হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে ২০১৬ সালে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুল দেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান। ফেরার পথে হামলার শিকার হন বদিউজ্জামান। তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। বাবরের নির্দেশে কুপিয়ে জখম করা হয় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদকে। কুপিয়ে জখম করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শওকত আলী জাহিদকে। কুপিয়ে জখম করা হয় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মনির হোসেনকে।
রেহাই পাননি সাংবাদিকরাও : বাবরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে রেহাই পাননি সাংবাদিকরাও। মোহনা টিভির সাংবাদিক আশীষ পোদ্দার হামলার শিকার হয়েছেন বাবরের কর্মী বাহিনীর হাতে। হামলার শিকার হয়েছেন ইনকিলাবের জেলা প্রতিনিধি নাজিম বাকাউল। বাবরের নির্দেশে প্রথম আলোর ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি পান্না বালার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুরের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শ্রী অঙ্গনে। তার ভাই খন্দকার মোশাররফের (মন্ত্রী থাকাকালে) সামনে মঞ্চের পাশেই এ হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলার প্রধান কারিগর বাবরের মদদপুষ্ট খায়রুদ্দিন আহমেদ মিরাজ পরে মন্ত্রী মোশাররফ কর্তৃক পুরস্কৃত হয়ে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। বাবরের সাগরেদ খায়রুদ্দিন মিরাজের হাতে পরে লাঞ্ছিত হন ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এম এ হালিম। এ ছাড়া প্রথম আলোর ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধির স্ত্রীর আত্মহত্যাজনিত ঘটনাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে হত্যা মামলা দেওয়া এবং সারা শহরে পোস্টার-লিফলেট-ব্যানার টাঙিয়ে ফাঁসির দাবি করে যে কর্মকাণ্ড ২০১৪ সালে ঘটানো হয়েছে, তার নেপথ্য নায়ক ছিলেন মোহতেশাম হোসেন বাবর। পরে ওই মামলা থেকে বেকুসুর খালাস পান সাংবাদিক পান্না বালা। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পর্দা কেলেঙ্কারির মূল হোতা ছিলেন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর ও তার সহযোগী বিল্লাল হোসেন। পর্দা দুর্নীতি মামলা বর্তমানে দুদকে তদন্তাধীন রয়েছে।
হঠাৎ ধরাশায়ী প্রতিপক্ষের কাছে : ২০১৭ সালে ভাই খন্দকার মোশাররফের সঙ্গে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যয়ভারের টাকা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ওই নির্বাচনে বাবর নির্বাচনী খরচ বাবদ বড় ভাই মোশাররফ হোসেনকে কোনো টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। সেই থেকে ঢাকায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন বাবর। ফরিদপুরে আর তাকে আসতে দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে একবার লুকিয়ে ফরিদপুরে এলেও দুদিনের মাথায় তাকে আবার ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ২০২০ সালের ১৬ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৮ মে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন সুবল সাহা। এই মামলার সূত্র ধরে ওই বছরের (২০২০) ৭ জুন রাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে খন্দকার মোশাররফের আস্থাভাজন দুই শিষ্য সমালোচিত দুই ভাই বরকত-রুবেল গ্রেপ্তার হন। সেদিন রাতে (৭ জুন, ২০২০) বরকত-রুবেলের সঙ্গে তাদের সহযোগী আরও ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন সাংসদ খন্দকার মোশাররফ। বর্তমানে তিনি ঢাকায় একরকম নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।
যে মামলায় গ্রেফতার বাবর : খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা অর্থ পাচার মামলায়। ২০২১ সালের ৩ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) উত্তম কুমার সাহা ১০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হন বাবর। এ মামলার অপর আসামিরা হলেন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত, তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল, ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী, শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের এপিএস এএইচএম ফুয়াদ, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাহিম, কামরুল হাসান ডেভিড, মুহাম্মদ আলি মিনার ও তারিকুল ইসলাম নাসিম। আসামিদের মধ্যে মুহাম্মদ আলি মিনার ও তারিকুল ইসলাম নাসিম পলাতক রয়েছেন। এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর বর্তমানে জামিনে আছেন খন্দকার নাজমুল ইসলাম লেভি ও আসিবুর রহমান ফারহান।