জামিল আহমদ 17 January, 2022 09:16 AM
বৈশ্বিক মহামারী মরণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন-নাসিকের তৃতীয় নির্বাচন অনষ্ঠিত হয়েছে। ইভিএমের এ ভোটে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ পাঁচ দলের পাঁচজন এবং দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিয়েছেন। মেয়র হিসেবে টানা দুই মেয়াদ কাটানো ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার থাকায় এ নির্বাচন নিয়ে সব মহলেরই আগ্রহ ছিলো, তবে এবার আগের সেই উত্তাপ ছিলো না। এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে স্বস্তির সঙ্গে বিদায় নেওয়ার প্রত্যাশায় ছিলো নানা সমালোচনায় থাকা কে এম নূরুল হুদার নির্বাচন কমিশনও।
এবারের নির্বাচনে সিটি করপোরেশনে মেয়রসহ ৩৭টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৮৯ প্রার্থী। এর মধ্যে মেয়র পদে সাতজন, ২৭টি ওয়ার্ডে ১৪৮ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ৯টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে ৩৪ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। মোট ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৭ জন ভোটারের এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৪ এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৯ জন। তৃতীয় লিঙ্গের চারজন ভোটার ছিলেন। বৈধ ভোট পড়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৯১১টি। ভোট বাতিল হয়েছে ৭৭১টি। তরা ১৯২টি ভোটকেন্দ্রের এক হাজার ৩৯৬টি ভোটকক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
১৯২টি কেন্দ্রের ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সদ্য বহিস্কৃত নেতা তৈমুর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। সে হিসাবে তৈমুরের চেয়ে ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট বেশি পেয়েছেন আইভী। অপর মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাছুম বিল্লাহ হাতপাখা প্রতীকে ২৩ হাজার ৯৮৭ ভোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন দেয়ালঘড়ি প্রতীকে ১০ হাজার ৭২৪ ভোট, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস হাতঘড়ি প্রতীকে ১ হাজার ৯২৭ ভোট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসিম উদ্দিন বটগাছ প্রতীকে ১ হাজার ৩০৯ ভোট এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল ইসলাম ঘোড়া প্রতীকে ১ হাজার ৩০৫ ভোট পেয়েছেন।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের সমর্থিত ১৪ জন জয়ী হয়েছেন। বিএনপি নেতা ও সমর্থকেরা জয় পেয়েছেন ৯টি ওয়ার্ডে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির (জাপা) দুজন, বাসদের একজন ও স্বতন্ত্র একজন নির্বাচিত হয়েছেন।
কাউন্সিলর পদে জয়ী যারা : ১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আনোয়ার হোসেন, ২ নম্বরে বর্তমান কাউন্সিলর বিএনপি নেতা মো. ইকবাল হোসেন, ৩ নম্বরে বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের শাহজালাল বাদল নির্বাচিত হন। শাহজালাল বাদল বহুল আলোচিত সাত খুন মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেনের ভাতিজা। এছাড়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডে নূর হোসেনের ভাই আওয়ামী লীগের নূর উদ্দিন নতুন করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও বিএনপির সাবেক সাংসদ জি এম গিয়াস উদ্দিনের ছেলে গোলাম মুহাম্মদ সাদরিল ও ৬ নম্বরে বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের মতিউর রহমান নির্বাচিত হয়েছেন। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের রুহুল আমিন মোল্লা, ৯ নম্বরে বর্তমান কাউন্সিলর বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া ইস্রাফিল প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের ইফতেখার আলম, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক অহিদুল ইসলাম, ১২ নম্বরে বর্তমান কাউন্সিলর বিএনপির শওকত হাসেম, ১৩ নম্বরে বর্তমান কাউন্সিলর বিএনপির মাকসুদুল আলম খন্দকার নির্বাচিত হয়েছেন। মাকসুদুল স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলমের ছোট ভাই। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনিরুজ্জামান, ১৫ নম্বরে বর্তমান কাউন্সিলর বাসদ নেতা অসিত বরন বিশ্বাস, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের রিয়াদ হাসান বিজয়ী হয়েছেন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের মো. আবদুল করিম, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে শ্রমিক লীগ নেতা কামরুল হাসান, ১৯ নম্বরে জাপার মোখলেছুর রহমান চৌধুরী, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির মোহাম্মদ শাহেনশাহ, ২১ নম্বর ওয়ার্ডে স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহিন মিয়া, ২২ নম্বরে বিএনপির সুলতান আহমেদ, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাউসার বিজয়ী হন। আবুল কাউসার নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ আবুল কালামের ছেলে। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর জাপার আফজাল হোসেন, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর বিএনপির এনায়েত হোসেন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর বিএনপির মো. সামসুজ্জোহা, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সিরাজুল ইসলাম বিজয়ী হয়েছেন।
সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে জয়ী যারা : সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে যথাক্রমে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে মাকসুদা মোজাফফর, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে মনোয়ারা বেগম, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মোসাম্মৎ আয়শা আক্তার জয়ী হয়েছেন। এছাড়া ১০, ১১, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে মিনোয়ারা বেগম, ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে শারমীন হাবিব, ১৬, ১৬ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে আফসানা আফরোজ, ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে শিউলি নওশাদ, ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে শাওন অংকন ও ২৫, ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সানিয়া আক্তার বিজয়ী হয়েছেন। সানিয়া ছাড়া বাকি সবাই বর্তমান কাউন্সিলর।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাস : ১৭৬৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী থেকে বিকন লাল পান্ডে (যিনি বেনু ঠাকুর বা লক্ষী নারায়ণ ঠাকুর পান্ডে নামে পরিচিত ছিলেন ) কয়েকটি মৌজা লিজ গ্রহণ করেন। এ জায়গায় পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ নগর গড়ে উঠে। বৃটিশ সরকার ১৮৭৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ২৭,৮৭৬ জন জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৪.৫ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা গঠন করে। ৪ জন মনোনীত এবং ৮ জন নির্বাচিত কমিশনার নিয়ে এ পৌরসভার অভিযাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা একটি “মডেল পৌরসভা” হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। রাজধানী “ঢাকার প্রবেশ দ্বার” হিসেবে পরিচিত। সড়ক, ট্রেন ও স্টিমার সার্ভিস সম্বলিত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নারায়ণগঞ্জ নগরকে পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত করে তোলে। এ জন্য নারায়ণগঞ্জ বিশ্বময় “প্রাচ্যের ডান্ডি” হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। বৃটিশ সরকার ১৮৭৬ সালে এইচ টি উইলসন-কে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম বাঙ্গালী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ মালেহ। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর পর ১৯৭৭ সালে তিনি পুনরায় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জনাব নাজিম উদ্দিন মাহমুদ চার বছর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর (১৯৮৮-২০০৩) নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিল না। উক্ত সময় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা প্রশাসক কর্তৃক পরিচালনা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে পুনরায় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রয়াত আলী আহাম্মদ চুনকার সুযোগ্য কন্যা ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০০৩ সালের পৌর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে ২০১১ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী পৌরসভা ছিল। ৫ মে ২০১১ তারিখে এ তিনটি পৌরসভা যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুল কে একীভুত করে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠা বিধিমালা ২০১০ এর বিধি ৬-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার প্রায় ৭২.৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে।নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সিটি নির্বাচনে পুনরায় ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ২য় সিটি নির্বাচনে টানা ৩য় বারের মত মেয়র নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
-এজেড