তারেকুল ইসলাম 02 January, 2022 02:33 PM
নতুন বছর মানেই নতুন প্রেরণা ও আশা। বিদায়ী বছরের আনন্দ-বেদনা ও সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান শেষে নতুন উদ্যমে নতুন বছরের যাত্রা শুরু করতে চায় সবাই। গেলো বছরের নানা চড়াই-উৎরাই পার করেও দেশের মানুষ নতুন বছর নিয়ে আশাবাদী হতে চায়। কিন্তু দেশের দীর্ঘ রাজনীতিশূন্য অবস্থায় মানুষের আশা ও আকাক্সক্ষা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। সাধারণ মানুষ আজ অসহায় ও জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলগুলো দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। এই না-পারার ব্যর্থতার মাশুল দিয়ে যেতে হচ্ছে জনগণকে। চেতনার নামে দেশকে বিভেদ-বিভক্তির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে বহু আগেই। চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যায্য শাসন। সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিবি) চেয়ারপারসন ড. রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘এখনো অন্যায্য সরকারব্যবস্থার মধ্যে আমরা রয়েছি। শাসন পদ্ধতি ন্যায়সঙ্গত নয়। পুরো ব্যবস্থায়ও একটি অন্যায্য সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে।’ বস্তুতপক্ষে, ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগণের সরকার ও জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে জনবিচ্ছিন্ন ও সুবিধাবাদীরা এমপি-মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে আর দেশ যাচ্ছে রসাতলে।
এরই মধ্যে কক্সবাজারে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেড়াতে গিয়ে এক গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বামী-সন্তানকে তুলে নিয়ে আটকে রেখে গৃহবধূকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে পালাক্রমে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। অভিযুক্ত ধর্ষকরা স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অনুসারী বলে জানা যায় (২৩ ডিসেম্বর ২০২১, জাগোনিউজ)। সুশাসনের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং পর্নোসাইটের সহজলভ্যতার কারণে ধর্ষণকান্ড অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনার সাথে কোনো-না-কোনোভাবে ক্ষমতাসম্পর্কও জড়িত থাকে। এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ- সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সাথে তার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ বুঝিয়ে দিয়েছে, ধর্ষণের সাথে অনৈতিক ক্ষমতাচর্চার সম্পর্ক কতটা গভীর। সচেতন বিবেক সমাজের প্রশ্ন- কীভাবে এমন বিকারগ্রস্ত ও ধর্ষকামী লোক মন্ত্রিসভায় স্থান পেলো? এছাড়া যখন কুমিল্লার কুরআন অবমাননার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে একের পর এক হামলা চলছিল, ঠিক তখনই অযাচিতভাবে এই কথিত ‘প্রতিমন্ত্রী’ মুরাদ হাসান সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের হুমকি দিয়েছিল। প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করাটা মূলত কাদের এজেন্ডা? এর ফায়দা কার পক্ষে যাবে? কারণ, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কখনো রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের কথা বলেননি। ২০১১ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে দুজন মন্ত্রী যখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি জানান, তখন শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদের কিছু উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ একটি রাষ্ট্রের অন্যতম ব্রাহ্মণ্যবাদী এজেন্ডা হলো বাংলাদেশের সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করানো। আর এদেশের শাহবাগী বাম সেকুলাররা সেই আধিপত্যবাদী এজেন্ডারই বরকন্দাজ। তারা সময়ে-সময়ে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের দাবিতে হুক্কা-হুয়া রব তোলে। অথচ দেশে গণতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে তাদের কোনো আওয়াজ নেই। খুব সম্প্রতি আধিপত্যবাদী শক্তির মদদে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের দাবিতে শাহবাগে আরেকটা গণ-পিকনিকের আয়োজনের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু কল্কে পায়নি। ২০১৩ সালের মতো এবার ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে সেই আধিপত্যবাদী শক্তির এজেন্ডা খাপ খায়নি। ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারিতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার লিড নিউজের শিরোনাম ছিল: 'India backs Shahbagh protest' (শাহবাগ আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে ভারত)। সে রিপোর্টে খোলাখুলি লেখা হয়েছিল-‘The protesters at Shahbagh have probably their strongest support from neighbour India.’’ সুতরাং, বাংলাদেশ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী এজেন্ডা ও তৎপরতার ব্যাপারে দেশের মানুষকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই অবগত যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের দাবিতে লাফালাফি করার জন্য ওসব উচ্ছিষ্টভোগী বাম সেকুলারদের কোথা থেকে কাতুকুতু দেয়া হয়।
সেকুলাররা বলে থাকে, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করলে দেশ ‘প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠবে। আসলেই কি তাই? অথচ, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা সত্তে¡ও কুমিল্লায় পূজামন্ডপে কুরআন অবমাননার ঘটনা ঘটেছে। তারা কি এটার জবাব দিতে পারবে? সবসময় সংখ্যাগুরু মুসলিমদের ওপর ‘সাম্প্রদায়িকতা’র অপবাদ দেয়া এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের ওপর সব আক্রোশ ঝাড়া হয়, যা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকাকালীনই রাসূল সা.-এর অবমাননাসহ নানাভাবে এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে একের পর এক আঘাত করা হয়েছে। আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এসবের প্রতিবাদে কখনো সেকুলারদের ন্যূনতম আওয়াজ করতে দেখা যায় না। অথচ, সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হওয়া মাত্রই তারা সমস্বরে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। কারণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতেই সেকুলাররা ঢালাওভাবে তথাকথিত ‘মৌলবাদ’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা’র হুজুগ তুলে আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের ব্যাশিং করার সুযোগটা পায়। তাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের মূল কারণ এটাই।
সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সেদিনই বাতিল হতে পারে, যেদিন এদেশের মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহারা হয়ে পড়বে। স্মরণ যোগ্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-অধ্যুষিত সমগ্র ভারতবর্ষকে ক্ষুদ্রসংখ্যক মুসলিম মোঘল বাদশাহরা কয়েক শতাব্দিব্যাপী শাসন করেছিলেন। তখন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলিম বাদশাহদের মানবিক ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে পেলেও হিন্দুত্ববাদীরা শাসক হলে সংখ্যালঘুদের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে, আজকের মোদি-অমিত-যোগী আদিত্যনাথের শাসন দেখলেই বুঝা যায়। সুতরাং, এদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে ইসলামই মূল প্রেরণা ও ভিত্তি।
যা হোক, নতুন বছরে আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর পথ চলতে হবে। এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংলাপ চলছে। আগামী ১৪ ফেব্রæয়ারিতে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। তাই বলা হচ্ছে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যই এই ‘সংলাপ’। যদিও বিজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের ভূমিকা সামান্যই; এমনকি তারা ‘রাষ্ট্রপতির সংলাপ’কে সংবিধানসম্মত নয় বলে মনে করছেন (২১ ডিসেম্বর ২০২১, নিউজ টোয়েন্টিফোর চ্যানেল)। এছাড়া সংবিধানে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের কথা বলা হলেও দুঃখজনকভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সে আইন করা হয়নি। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে এই আইনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে। উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।’ কিন্তু রাষ্ট্রপতির এই এখতিয়ার সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শর্তসাপেক্ষ। এখানে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়েই কাজ করতে হবে। তাই সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে এই শর্তের বিলোপ চেয়েছেন দেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এছাড়া তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পেতে আইন করার দাবিও জানিয়েছেন (২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ডয়েচে ভেলে)।
অন্যদিকে, সিপিবিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ইসি পুনর্গঠন ইস্যুতে চলমান সংলাপে অংশ নিতে আগ্রহী নয় বলে জানিয়েছে। তারা এ ধরনের সংলাপকে কার্যকর বা অর্থবহ মনে করতে পারছে না। এছাড়া দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইসি পুনর্গঠনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের অধীনে আয়োজিত আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়। এমতাবস্থায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আরেকটি রাজনৈতিক অচলাবস্থার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। সম্ভাব্য রাজনৈতিক অচলাবস্থা এড়াতে হলে দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন কমিশন গঠনপূর্বক সবার অংশগ্রহণমূলক একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এতে করে জনগণও তাদের হারানো ভোটাধিকার ফিরে পাবে এবং তাদের পছন্দের দলকে নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে। এর অন্যথা হলে সেটা হবে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অশুভ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন কিংবা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নৈশকালীন ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না দেশের মানুষ। তারা তাদের ভোটাধিকার ও নাগরিক-মানবিক অধিকারসমূহ ফিরে পেতে অধীর হয়ে আছে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক