09 May, 2020 05:28 PM
মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ (৭৬) দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার পর আজ শুক্রবার সকাল ৭ টা ২৫ মিনিটে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ইন্তিকাল করেছেন।
ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন ।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
আপোষহীন ইসলামী সিপাহসালার মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ঔরসে ১৯৪২ সালে লালবাগ কিল্লার মোড়ে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. জীর্ণ কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন। দাদার নাম মাওলানা ইদরীস সাহেব। তিনি উর্দূ-ফার্সি ভাষায় সুদক্ষ ও সমাজে সুপরিচিত আলেম ছিলেন। পরদাদা মাওলানা মুন্সি আকরাম উদ্দিন রহ, ছিলেন বালাকোটের শহিদ সৈয়দ আহমেদ বেরলভী রহ.এর সুযোগ্য খলিফা।
শিক্ষাজীবন:
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ পিতা হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর কাছেই পবিত্র কুরআনের প্রথম সবক গ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন মুন্সিগঞ্জ জেলাধীন বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় অকতঃপর লালবাগ মাদরাসায়। তারপর ইলমে নববী অর্জনের লক্ষ্যে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান পাকিস্তানের জামিয়া ইসলামিয়া বিননূরী টাউন মাদরাসায়।
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ছাত্র জামানা থেকেই বড় বড় ওলামায়ে কেরামের কাছে আসা-যাওয়া করেন। তাদের নেক দৃষ্টি ও সোহবত লাভ করেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সন্তান হিসেবে তারাও তাঁকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাওলানা ইউসুফ বিননূরী রহ., মুফতি মাহমূদ রহ., মুফতি শফি রহ., মাওলানা যফর আহমাদ উসমানী, মুফতি সলীমুল্লাহ খান রহ., মুফতি আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. প্রমূখ বিজ্ঞ ও যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরাম।
কর্ম জীবন:
পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ১৯৬৩ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর নির্দেশে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রধান মুয়াজ্জিন হিসেবে খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন।
কামরাঙ্গীরচর মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ:
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ইন্তেকালের পর মাওলানা ক্বারী আহমাদুল্লাহ আশরাফ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপিঠ জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়ার (মাদরাসা-ই নূরিয়া’) মুহতামিম পদে নিযুক্ত হন। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ যাবৎ মাদরাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছে। অসুস্থতা ও কর্ম অক্ষমতার কারণে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর খেলাফত আন্দোলনের প্রতিনিধি সম্মেলনে খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়তের দায়িত্ব এবং ২০১৫ সালের ৬ আগষ্ট জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া (মাদরাসায়ে নূরিয়া) এর মুহতামিমের দায়িত্ব তার ছোট ভাই মাওলানা ক্বারী শাহ আতাউল্লাহ দা.বা.এর কাছে হস্তান্তর করেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি মাদরাসার সারপুরস্তে আ’লা ছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন:
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফের জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে রাজনীতির ময়দানে। ছাত্র জীবন থেকেই আল্লাহর জমীনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্যে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামসহ বিভিন্ন দ্বীনী সংগঠনের কাজে সহযোগিতা করেন। ১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর তওবার রাজনীতির আন্দোলনে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।
খেলাফত আন্দোলনের আমীর নির্বাচিত:
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. বলতেন, আমার আকাক্সক্ষা- খেলাফত আন্দোলন যেন একদিনের জন্যও আমীরবিহীন না থাকে এবং আমার জানাজা যেন ‘আমীরের’ অধীনে হয়। হযরত যখন অসুস্থ হয়ে যান তখন বললেন, ‘আমি আমার অবর্তমানের জন্য অতি সাময়িকভাবে আমার বড় বেটা মিয়া ক্বারী আহমাদুল্লাহকে আমার ক্বায়েম মুক্বাম করে দিলাম। পরবর্তীতে আপনারা কোন যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করতঃ এ মহা গুরু দায়িত্বভার তার হাওয়ালা করবেন। ও তাঁর জন্য সকলে দোয়া করতে থাকবেন।’
হযরত হাফেজ্জী হুজুর এর ইন্তেকালের পর তাঁর আকাক্সক্ষা মোতাবেক অস্থায়ীভাবে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ সংগঠনের দায়িত্বশীল হন। হযরতের জানাজার পূর্বাহ্ণে মরদেহের উপস্থিতিতে ৮ ই রমজান ১৪০৭ হিজরী, ৭ই মে ১৯৮৭ ইং শুক্রবার সকাল ৯টায় জামেয়া কোরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় সমবেত দলের নেতা ও কর্মীদের এক সভা খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর হযরত মাওলানা ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে এই প্রথম গুরু দায়িত্ব নিতে হয়। পরবর্তীতে ১ মাস ২৭ দিন পর ৬ জিলক্বদ মাদরাসা-ই নূরিয়ায় আহুত দলের ঐতিহাসিক সর্ববৃহৎ মজলিসে শূরায় তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ‘আমীরে শরীয়ত’ নির্বাচিত হন এবং এ অধিবেশনেই সকল সদস্যদের বায়আ’ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ থেকে গত ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ইং তারিখ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসী ভূমিকা
১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাাকাও। ক্ষুদ্র, অসহায় ব্যবসায়ীদের উপরে পাক বাহিনী যখন জুলুম-নির্যাতন করছিল, তখন মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ বীরবিক্রমে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এবং সরাসরি পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। এক পর্যায়ে তারা মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ এর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে বেধড়ক প্রহার করে রক্তাক্ত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ঐদিকে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর কাছে গ্রেপ্তারের সংবাদ আসলে তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে সরাসরি আল্লাহর কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। হত্যার উদ্দেশ্যে বন্দুক তাক করে দাড় করানো হয়েছিল মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে। হাফেজ্জী হুজুরের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাদের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে বন্দুকের নলের সামনে থেকে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে রক্ষা করেন।
কারাবরণ
২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নারী নীতিমালা ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে আন্দোলনরত অবস্থায় জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ গ্রেফতার হন। তাঁর গ্রেফতারির প্রতিবাদে পরের দিন সারা দেশে শান্তিপূর্ণ হরতাল ও বিক্ষোভ পালিত হয়।
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমে খেদমতকালীন বাইতুল মুকাররমের দক্ষিণ গেইট সংলগ্ন একটি ক্লাবে মদ ও জুয়ার আসর বসত। মাওলানা আশরাফ একদিন জুমার নামাযের পর মুসল্লীদের নিয়ে এর জোড়ালো প্রতিবাদ করেন। তৎকালীন সরকার তখন তাঁকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে মুসল্লীদের আন্দোলনে সরকার তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
বাতিল প্রতিরোধে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ:
অন্যায় ও বাতিল প্রতিরোধে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ছিলেন এক দুঃসাহসী সিপাহসালার। সকল জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদা তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।
সাহসী বক্তব্য:
চরিত্র-মাধূর্য্য:
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর হাতেগড়া সুযোগ্য সাহেবজাদা মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ শৈশবকাল থেকেই উত্তম চরিত্র, সদ্ব্যবহার, সহনশীলতা, সবর, উদারতার গুণের অধিকারী।
সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সবশ্রেণীর মানুষের সাথে কথা-বার্তা বলেন।
গরীব-দুঃখীর পাশে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ:
এতীম, অসহায়, গরীব-দুঃখীর জন্য তিনি নিবেদিতপ্রাণ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। রাস্তা থেকে এতীম-গরীব, অসহায়দের কুড়িয়ে এনে অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। যাদের অনেকেই আজ কুরআনুল কারীমের হাফেজ, মাওলানা হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। বায়তুল মোকাররম খেদমত অবস্থায় বহু ছিন্নমূল, বাস্তহারা, পথ শিশুদেরকে মাদরাসায়ে নূরিয়ায় কুড়িয়ে এনে তাদের খাদ্য, বাসস্থান ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। যাদের অনেকে আজ ধনাট্য ও সামাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্য।