রহমত নিউজ 17 October, 2023 09:21 AM
বাংলাদেশে ডলারের দাম নিয়ে আবারো নানা বিতর্ক সামনে এসেছে। প্রতি ডলারে সরকার নির্ধারিত ১১০ টাকার পরিবর্তে ব্যাংকগুলো আরো বেশি দামে ডলার কিনছে বলে খবর সামনে আসছে। এরইমধ্যে নির্ধারিত দামের তুলনায় বেশি দাম ডলার কেনাবেচার জন্য গত পহেলা অক্টোবর ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর এই ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে কেনো জরিমানা করা হবে না তা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেসব ব্যাংক এই চিঠি পেয়েছিলো সেগুলো হলো- এক্সিম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ব্যাংক। এছাড়া সোমবার স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরেও বলা হচ্ছে যে, নির্ধারিত দামের তুলনায় বেশি দামে ডলার কিনছে ব্যাংকগুলো। আর এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সায় আছে বলেও দাবি করা হচ্ছে এসব প্রতিবেদনে। তবে ব্যাংকগুলোতে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন, বিষয়টি সম্পর্কে তাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ ধরণের কোন নির্দেশনাও দেয়া হয়নি।
বিনিময় হার কেনো ছাড়া হয় না?
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বরাবরই বলে আসছে, তারা ডলারের দাম নির্ধারণ করে না। বরং দেশের ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপরই ছাড়া রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের নির্বাহীদের প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) মিলিতভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করে থাকে। বাফেদা কিন্তু বাজারের ডিমান্ড-সাপ্লাই অ্যাসেস করেই দামটা নির্ধারণ করে। বাফেদা তো হঠাৎ করে কোন বেসিক ছাড়া করে না (দাম নির্ধারণ)। সুতরাং এটা বাজারের পার্টিসিপেন্টরাই নির্ধারণ করে।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপর ছাড়া হয়নি। আর এ কারণেই ডলারের একাধিক বিনিময় হার প্রচলিত রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম বাজারের উপর ছাড়া নিয়ে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের এক ধরণের স্পর্শকাতরতা আছে। তারা মনে করে একবার দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে সেটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ঠিক বলা যায় না। এছাড়া এটা আবার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান বাংলাদেশ ব্যাংক। একটা মিসট্রাস্ট (অবিশ্বাস) বাজারের উপর আছে। তারা মার্কেটকে পুরোপুরি ছাড়ে নাই কোনও দিনই, আর এখনো ছাড়ছে না।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তারা ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপরই ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে একটা ভয়ের ব্যাপার আছে। কারণ বাংলাদেশে বাজার নিয়ন্ত্রণ বা এর উপর নজরদারি করা সহজ নয়। ফলে ব্যাংক, মানি চেঞ্জার এবং কার্ব মার্কেটে, ডলারের দাম অনেক উপরে উঠে যাবে। এতে করে যাদের দরকার তারা ডলার পাবে না। তবে এই ভয়কে খুব একটা যুক্তিসঙ্গত না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেটা করছে যে, আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে আলাদা বিনিময় হার - সেটার উপর মানুষের আত্মবিশ্বাস নেই। কারণ সেই দামে ডলার পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যারা রেমিটেন্স পাঠায় তারাও দেখছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক একেক সময় একেক কথা বলছে। অনানুষ্ঠানিক ভাবে ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে ডলার কেনার মৌখিক অনুমতি দিচ্ছে। ফলে এই ব্যাংকের উপর তাদেরও আস্থা নেই। এতে করে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির ব্যবহার বাড়ছে।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি হয়েছে তা অভূতপূর্ব উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একদিকে যেমন দাম নির্ধারণের উপর নিয়ন্ত্রণটা রাখতে চাইছে, অন্যদিকে তেমনি নিয়ন্ত্রণের কারণে বাইরে থেকে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যেহেতু এখন সময়টা খারাপ, ইলেকশনের সময় প্রচুর টাকা পাচারও হচ্ছে, তারা সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে ব্যাংকগুলোকে অলিখিতভাবে এটা ফরমাল অ্যারেঞ্জমেন্ট নয়, এটা ইনফরমাল অ্যারেঞ্জমেন্ট, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বলে দেয়া যে তোমরা বেশি দামে কিনতে পারো। এটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, আনুষ্ঠানিকভাবেই বরং এই প্রক্রিয়াটা গ্রহণ করা উচিত।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হলে টাকাকে যে পরিমাণ আনুষঙ্গিক সহযোগিতা দিতে হবে, নির্বাচনের আগে হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি দিতে প্রস্তুত নয়।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, পলিটিকাল ইকোনমি, ইলেকশন ইস্যু এগুলো তাদের ব্যবস্থাপনাটাকে জটিল করে ফেলেছে। ফলে একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যাচ্ছে। এটাকে বেশি দিন এভাবে রাখাটা ঠিক হবে না। বিনিময় হার উন্মুক্ত করতে হলে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, ঋণের সুদের হারের উপর থেকে ক্যাপ তুলে ফেলা বা সুদ হার নির্ধারণ করে না দেয়া। মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি কমে না-আসা পর্যন্ত সুদের এই হার বাড়াতে হবে। একই সাথে বাজারের উপর কঠোর নজরদারিও থাকতে হবে। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বাংলাদেশে ব্যাংকের টাকা না ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে এধরণের কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ হারানোর যে ভয় পাচ্ছে সেটি একেবারে অমূলকও নয় বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই টাইটেনিংটা দরকার আছে। এই টাইটেনিংটা যদি একসাথে না দিতে পারে তাহলে কিন্তু ডলারের মূল্যটা ধরে রাখাটাও কঠিন হয়ে যাবে। এটাকে একটা সাপোর্ট দিয়েই বাজারের হাতে ছাড়তে হবে। ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে মূল্যস্ফীতি স্বল্প মেয়াদে বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে তা কমে আসবে। কারণ বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়ার বিষয়টি যতটা না ডলার সংকটের উপর নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, বাজারের উপর নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণের অভাব, সরবরাহ না থাকা, মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীদের লাগামহীন লাভ করার মানসিকতা, চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলোর উপর।
ছেড়ে দেয়া না হলে কী হবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে বাইরে থেকে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হলেও বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপরেই ছেড়ে দেয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজারের চাহিদা বেশি থাকার পরও যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ১১০ টাকায় ধরে রাখে, তাহলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলার আসাটা কমে যাবে। এতে রিজার্ভের উপর চাপ আরো বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া না হলে মূল প্রভাবটিই পড়ে রেমিটেন্সের উপর। নিয়ন্ত্রিত হারের কারণে মানুষ রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহী হয় না। এছাড়া দেশীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিনিময় হার বাজারের উপর ছাড়া না হলে নতুন বিনিয়োগ যেমন আগ্রহী হয় না, তেমনি যারা এরইমধ্যে বিনিয়োগ করেছেন, তারাও আর মূলধন বাড়াতে চায় না। কারণ ডলারের দামের উপর তাদের আস্থা থাকে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একেক দিন একেক কথা বলে, এইটার (বিনিময় হার) উপর যদি আস্থা না থাকে তাহলে তো এমনিই আসবে না। এর ফলে হুন্ডির ব্যবহার যেমন লাগাম ছাড়া হবে তেমনি ডলারের প্রবাহও কমে যাবে। একই সাথে বিদেশি বিনিয়োগও যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে রিজার্ভও বাড়বে না। আর রিজার্ভ না বাড়লে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও ঠেকানো যাবে না। যেসব ব্যবসায়ী নানা ধরণের অতিপ্রয়োজনীয় মেশিনারিজ বা বাইরে থেকে কাঁচামাল আমদানি করে তাদের উপরও এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে। কারণ এলসি খোলার সময় তারা পর্যাপ্ত ডলার পায় না। বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত থাকলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ডলার না পেলেও যারা সুবিধাবাদী, যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, তারা ঠিকই ডলারের ব্যবস্থা করে ফেলে। এতে ব্যবসায়ে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকে না।
সমাধান কোথায়?
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেয়াটাই বাংলাদেশে ডলার সংকটের একমাত্র সমাধান নয়। বরং যেসব অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাংলাদেশে ডলার বিশেষ করে রেমিটেন্স আসছে সেগুলো বন্ধ করা না গেলে ডলার সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। ডলার আসার উপর একটা চাপ অবশ্যই আছে। আর সেটা হচ্ছে হুন্ডি। হুন্ডির কারণেই বিদেশে ডলারে চাহিদা অনেক বেশি বেড়েছে। এজন্য একটা অ্যাগ্রেসিভ অ্যাকশন নেয়া যায় কিনা এই জিনিসটাকে পুরোপুরি বন্ধ করার জন্য, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি দুই-চার জনকে না ধরতে পারেন তাহলে তো এটা চলতেই থাকবে। তবে একই সাথে ডলারের বিনিময় হার যদি বাজার দরের কাছাকাছি নিয়ে আসা যায় তাহলে সেটা খারাপ হয় না। ডলারের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হলে ডলার সংকট সমাধানে সেটি সহায়ক হতে পারে। তবে একই সাথে হুন্ডির ব্যবহারও কমিয়ে আনতে হবে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা