| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক নীরবে ধ্বংস করা হচ্ছে একটি গণতন্ত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস


ছবি : নিউ ইয়র্ক টাইমস

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

নীরবে ধ্বংস করা হচ্ছে একটি গণতন্ত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     03 September, 2023     05:08 PM    


১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশের জনবহুল আদালত কক্ষে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার বিরোধী দলের নেতা, সদস্য ও সমর্থক বিচারকের সামনে দাঁড়ান। অভিযোগগুলো সাধারণত অস্পষ্ট এবং প্রমাণগুলো সর্বোত্তমভাবে দুর্বল। নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্থিরতার প্রভাব স্পষ্ট। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ৫০ লাখ লোকের প্রায় অর্ধেকই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আদালতে মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে সক্রিয় নেতা এবং সংগঠকরা কয়েক ডজন, এমনকি শত শত মামলার মুখোমুখি হন।

সম্প্রতি সাইফুল আলম নীরব নামে এক নেতাকে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকার ১০ তলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। নীরবের বিরুদ্ধে ৩১৭ থেকে ৩৯৪টি মামলা রয়েছে- তিনি এবং তার আইনজীবীরা নিশ্চিত নন যে ঠিক কতগুলো। আদালতের বাইরে আরও ৪০০টি মামলার মুখোমুখি হওয়া এক ডজন সমর্থক একটি গলিতে অপেক্ষা করছিলেন। আব্দুল সাত্তার নামে একজন সমর্থক বলেন, 'আমি আর কোনো চাকরি করতে পারছি না।' তিনি ৬০টি মামলা মোকাবেলা করছেন এবং সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন আদালতে কাটান।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশ মূলত একটি 'অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প' হিসাবে পরিচিত। গার্মেন্টস রপ্তানি শিল্পের উপর দৃঢ় ফোকাস বাংলাদেশকে ডলারের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করেছে। অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক একীকরণের প্রচারণা শুরু করেছেন, যার লক্ষ্য দক্ষিণ এশীয় প্রজাতন্ত্রকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা বলে বিরোধী দলীয় নেতা, বিশ্লেষক ও অ্যাক্টিভিস্টরা মনে করছেন।

শেখ হাসিনার ১৪ বছরের শাসনকালে তিনি পুলিশ এবং ক্রমবর্ধমানভাবে আদালতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুগতদের দ্বারা পরিপূর্ণ করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভিন্নমত দমন করার জন্য ব্যবহার করেছেন। তার টার্গেটে রয়েছেন তার টার্গেটে রয়েছেন শিল্পী, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে একটি নির্বাচন প্রত্যাশিত হওয়ায় দেশটি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। বিরোধীরা এই ভোটকে শেষ লড়াই হিসাবে দেখছে। শেখ হাসিনার সহযোগীরা অনিশ্চিত ভাষায় বলছেন, তারা বিএনপিকে জিততে দেওয়া যাবে- তারা ক্ষমতায় এলে 'আমাদের মেরে ফেলবে।'

একটি সাক্ষাৎকারের সময় বিরোধীদের হয়রানি করার জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। তিনি সে সময় তার এক সহযোগীকে একটি ছবির অ্যালবাম নিয়ে আসতে বলেন। সেই অ্যালবামজুড়ে ছিল অসংখ্য অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ এবং অন্যান্য হামলার পর বিকলাঙ্গ মৃতদেহের গ্রাফিক ছবি। শেখ হাসিনা বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক নয়। এরপর বিএনপির ‘বর্বরতার’ উদাহরণ হিসেবে তিনি ছবিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, তাদের অপরাধের কারণেই এই বিচার হচ্ছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের প্রায় ৮০০ সদস্য নিহত হয়েছেন এবং চার শতাধিক নিখোঁজ হয়েছেন। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তার দলের প্রতি একই কাজ করেছিল, হাজার হাজার সমর্থককে জেলে ও হত্যা করেছিল। শেখ হাসিনা বলেন, তারা এটা শুরু করেছে।

গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের গল্প হচ্ছে, মূলত দুই শক্তিশালী নারীর মধ্যে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার। তাদের একজন হচ্ছেন শেখ হাসিনা (৭৫) এবং অন্যজন হচ্ছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া (৭৭)। শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব থেকে বড় নেতা ছিলেন। দেশ স্বাধীনের চার বছর পর তিনি একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রীই হচ্ছেন খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানও ১৯৮১ সালে সৈন্যদের হাতে নিহত হন।

শেখ হাসিনা বলেন, আসলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটা ছিল আমারই। এই বিরোধী দল গঠন করেছিল একজন সামরিক স্বৈরশাসক। অপরদিকে বিএনপি বলছে, তারাই বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।

২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হয়। এখন তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় এখন তিনি টেলিভিশন দেখা এবং সংবাদপত্র পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। তার ছেলে তারেক রহমান ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। বিএনপি অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে। বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন তারেক রহমান। এমন অবস্থায় দলের ডি ফ্যাক্টো নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে ৯৩টি মামলা। এর পেছনেই বড় একটি সময় ব্যয় করেন তিনি।

মহামারির কারণে বৈশ্বিক চাহিদা ব্যাহত হওয়ার পর বাংলাদেশ এখন তার পোশাক শিল্পকে আগের ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। তবে এমন সময় ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের কারণে আমদানি করা জ্বালানি এবং খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশে ডলারের সরবরাহ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। শেখ হাসিনা বলেন, এটি আমাদের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে বিরোধীদের দাবি অস্বীকার করেছেন শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে জনগণের মনে সৃষ্ট ক্ষোভের মধ্যে একটি সুযোগ দেখতে পেয়েছিল বিরোধী দল। জুন মাসে একটি বিশাল সমাবেশের সময় অবাধ নির্বাচন ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান বিএনপির নেতারা।

শাসক দল আওয়ামী লীগ এ সময় পাল্টা একটি সমাবেশ আয়োজন করে। সেখানে বক্তারা স্বীকার করেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দিকে নজর রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেশের সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ভিসা বিধিনিষেধের হুমকি দিয়েছে। মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সফর করেছেন।

বিএনপি এরপর আরেকটি বড় সমাবেশ করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর ক্লাবস ও টিয়ার গ্যাস হামলা চালায়। নতুন করে ৫০০ মামলা দেওয়া হয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এই ক্র্যাকডাউন দেখায় যে, পশ্চিমারা সতর্ক করলেও তা শেখ হাসিনার মতো নেতার উপর সীমিত প্রভাব ফেলে। তিনি এশিয়ার দুই প্রধান শক্তি চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছেন।

বাংলাদেশি আইনজীবী এবং প্রবাসে থাকা অ্যাক্টিভিস্ট আশরাফ জামান এশিয়ান মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, পুলিশ একটি মামলায় অনেক লোককে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ বা পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। একই মামলায় ডজন ডজন বা এমনকি শত শত ‘বেনামি ব্যক্তিদের’ রাখা হয় যাতে নতুন করে অন্যদেরও ওই মামলায় যুক্ত করা যায়।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিচারকের সামনে প্রমাণ উপস্থাপন করার আগেই অভিযুক্তরা মাসের পর মাস জেলে কাটান। এছাড়া জেলে তাদের হযরানি বা নির্যাতনের ঝুঁকি থাকে।

আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক মামলায় জামিন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পেলে, সরকার এটিকে একটি মহান উপহার হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু এ ব্যক্তিটিকে প্রথমেই যে আটক করা উচিত ছিল না তা অবশ্য মেনে নেয়া হয় না।

আশরাফ জামান বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সাধারণত আদালতে যুক্তি দেন যে- তাদের মক্কেলের একটি পরিবার আছে, তিনি ইতিমধ্যে দীর্ঘ সময় জেলে কাটিয়েছেন, তাই আপনি যদি দয়া করে তাকে জামিন দেন তবে আসামি কৃতজ্ঞ থাকবে। এরপরই প্রসিকিউশন মুক্তির অনুমতি দেয়।

রাজনৈতিক মামলার জন্য ব্যস্ততম স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। সেখানে জুনের এক সকালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিএনপি নেতা নিরবকে। তার আইনজীবী সৈয়দ নজরুল বলেন, তার মক্কেলের বিরুদ্ধে শহরের প্রতিটি থানাঢ অন্তত একটি করে মামলা রয়েছে। প্রতিদিন সকালে বিচার শুরু হওয়ার আগে বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনের ২০৫ নম্বর কক্ষে প্রায় এক ডজন আইনজীবী ভিড় করেন, যেখানে সৈয়দ নজরুল শেষবারের মতো কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। ১২ জুন অফিসের বড় খাতায় দেখা যায়, এই দলটি সেদিন ৩৩ জন ক্লায়ান্টদের হয়ে লড়েছে। এরমধ্যে ৩২টিতেই বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়িত। সৈয়দ নজরুল বলেন, শুনানি সর্বোচ্চ ২০ মিনিট ধরে চলে। এরপর সারাদিন কেটে যায় এই হয়রানির মধ্যেই।

কম্পিউটার প্রকৌশলী দিদারুল ভুঁইয়া অস্ট্রেলিয়ায় পডাশোনা শেষ করে ঢাকায় ফিরেছেন। তিনি একটি ছোট সফটওয়্যার কোম্পানি স্থাপন করেছেন, বিয়ে করেছেন এবং তিন ছেলেকে বড় করেছেন। কিন্তু প্রায়ই একটি প্রশ্ন তার মাথায় আসে, তার ফিরে আসার সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল? এরপরই তিনি সুশীল সমাজ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন, যার লক্ষ্য ছিল সিস্টেমে নজরদারি জোরদার করা। তার সন্তানরা যাতে বিদেশে জীবন কাটাতে বাধ্য না হয় সেটি নিশ্চিত করতে চান তিনি। দিদারুল ভুঁইয়া বলেন, কেউ ক্ষমতায় গেলেই তিনি আইনের ঊর্ধ্বে চলে যান। দিদারুল ভূঁইয়ার গ্রুপ মহামারি চলাকালীন ত্রাণ তহবিলের ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করার পর বেসামরিক পোশাকে নিরাপত্তা বাহিনী তাকে একটি ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যায়। তার স্ত্রী দিলশাদ আরা ভুঁইয়া তার স্বামীর জামিনের জন্য আদালত থেকে আদালতে দৌড়েছেন। কিন্তু তারা তার মামলা শুনতে অস্বীকার করেন, যদিও সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। বিচারকরা নাম ও মামলাটি দেখেই বলে দেন যে, ‘দুঃখিত, আমি পারবো না’। অবশেষে পাঁচ মাস জেলে থাকার পর জামিন পান তিনি। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অস্পষ্ট অভিযোগ তুলে তাকে গ্রেপ্তারের প্রায় এক বছর পরও পুলিশ কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। প্রমাণের মূল অংশ হিসেবে পুলিশ দিদারুল ভুঁইয়ার একটি ফেসবুক পোস্ট জমা দিয়েছে। সেটি আবার তিনি মুক্তির কয়েক মাস পর লিখেছিলেন।

দিদারুল ভুঁইয়ার গ্রেপ্তারের সময়ই গ্রেপ্তার হওয়া আরেক অ্যাক্টিভিস্ট মোশতাক আহমেদ জেলেই মারা যান। মোশতাক আহমেদের একটি বড় প্রতিকৃতী দিদারুল ভুঁইয়ার হোম অফিসে ড্রয়ারে রাখা আছে। তিনি মোশতাক আহমেদের মৃত্যুকে রাজনৈতিক হত্যা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, বিনা বিচারে কাউকে ১০ মাসের জন্য জেলে রাখা যে কাউকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট।


সূত্র : ইত্তেফাক