| |
               

মূল পাতা জাতীয় বাংলাদেশের অর্থনীতি কেনো ‘ভুল পথে যাচ্ছে’


বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

বাংলাদেশের অর্থনীতি কেনো ‘ভুল পথে যাচ্ছে’


রহমত নিউজ     31 August, 2023     10:37 AM    


বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘ভুল পথে’ চলছে বলে মতামত দিয়েছেন একটি জরিপে অংশ নেয়া বেশিরভাগ মানুষ। তারা মনে করেন, এর ফলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনও মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। জরিপে অংশ নেয়া সাধারণ মানুষের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদেরও ধারণা, গত কয়েক বছরে অর্থনীতি যেসব সংকট বা সমস্যার মুখে পড়েছে, সেগুলো সমাধানে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় সংকট আরো গভীর হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সরকার এমনটা মনে করছে না। সরকারের মতে, অর্থনীতিতে কিছুটা সমস্যা বা সংকট থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো সমাধানেও নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর আগে ২০১৯ সালে সর্বশেষ যখন এই জরিপটি চালানো হয়েছিল, তখন ৭০ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন যে, দেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই রয়েছে। চার বছরের ব্যবধানে অর্থনীতি নিয়ে মানুষের ধারণা পরিবর্তনের কারণ কী?

অর্থনীতি নিয়ে এরকম মতামতের কারণ কী?
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিরাজ চৌধুরী যদিও ওই জরিপে অংশ নেননি, কিন্তু দেশের অর্থনীতি যে ভালো নেই, সেটা তিনি নিজের জীবন থেকেই উপলব্ধি করছেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি বড়দের ব্যাপার, সেটা ভালো বুঝি না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করার পরেও আমার অর্থনৈতিক অবস্থা দুই বছরে আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। বেতন যা বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। দুইটা সেভিংস ছিল, ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছে। আশেপাশের অন্যদের অবস্থাও তো ভালো না। আমার এক বন্ধু এলসি খোলার জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে ঘোরে, এলসি খুলতে পারছে না। আমাদের মতো যাদের অবৈধ উপার্জন নেই, তাদের জন্য সংসার চালানো, তিন বেলা ডাল ভাত খাওয়াই কষ্টকর হয়ে উঠছে।

মিরাজ চৌধুরীর মতো আরো অনেকেই মনে করেন, দেশের অর্থনীতি ঠিক পথে চলছে না। তার প্রভাবে তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, উন্নয়ন, সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ওই জরিপটি পরিচালনা করেছে ওয়াশিংটন ভিত্তিক এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি)। গত বছরের নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলার ১০ হাজার ২৪০ জনের ওপর জরিপটি চালানো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের ৭০ শতাংশই মনে করেন, দেশের অর্থনীতি ভুল পথে চলছে। তিন বছর আগে এই হার ছিল ২৮ শতাংশ। এর ফলে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, ব্যবসায় মন্দা, বেকারত্ব ইত্যাদি সমস্যা তাদের জন্য গভীর আঘাত হিসাবে দেখা গিয়েছে।

অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, অর্থনীতি ঠিক মতো চলছে কিনা, তিনটি পক্ষ তা ভালো মতো বুঝতে পারছে। এক পক্ষ হলো জনগণ, কারণ তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের খাওয়া কমাতে হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। আরেক পক্ষ হলো ব্যবসায়ীরা যারা ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছেন না, আমদানি হচ্ছে না, ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। আর সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারেন সরকারি কর্মকর্তারাই। কারণ রিজার্ভ কমা, দারিদ্র বেড়ে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকা- এসব তো সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা সমাধানের, দ্রুত অবসানের তো কোন লক্ষণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

এর আগে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও এ ধরনের জরিপ করেছিল এশিয়া ফাউন্ডেশন ও বিআইজিডি। তখন দেশের অর্থনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে এতো নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়নি।

অর্থনীতি বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমিও মনে করি, অর্থনীতি ভুল পথে চলছে। তবে পথ কতখানি ভুল হয়েছে, সেটার চেয়ে বড় কথা সেই পথে কখন কোথায় বাঁক নিতে হবে, কোথায় থামতে হবে, যেটাকে আমরা সংস্কার বলি, সেখানে নীতি প্রণয়ন আর বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঘাটতি হয়েছে। এর ফলেই এসমস্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র কি?
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা তাদের ব্যক্তিজীবনের আর্থিক চাপ, মূল্যস্ফীতির কারণে ‘অর্থনীতি ভুল পথে’ রয়েছে বলে মন্তব্য করলেও বাস্তবে অর্থনীতির সমস্যাগুলো আরো ব্যাপক।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের রাজস্ব আদায়ের যে নিম্ন হার, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো খাতে বিনিয়োগ করতে না পারা, বৈদেশিক খাতের আর বিনিয়োগের ভঙ্গুর অবস্থা, রিজার্ভের খারাপ অবস্থা, এমনকি আইএমএফের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে না পার- সব সূচকই তো নেতিবাচক হয়ে পড়ছে। এর ফলে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির পাশাপাশি বাজারের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরো আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, জুন মাসের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৭৪ শতাংশ। রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে। রফতানি আয় কিছুটা বাড়লেও প্রবাসী আয় কমেছে। গত বছর এই সময়ে ডলার ৯৫ টাকায় লেনদেন হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১১০ টাকা দরে। সব ধরনের আমদানি প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে।

ড. ভট্টাচার্য বলেন, সাধারণ মানুষ বলে থাকলে সেটা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় যে বেড়ে যাচ্ছে, সেটার কারণে বলেছে। কারণ এর ফলে তারা সরাসরি চাপে পড়েছে। কিন্তু সেই চাপ কমানোর কোন চেষ্টা সরকারের একদম নেই। কারণ সরকারের মন্ত্রী বা কর্মকর্তারা প্রথম থেকেই অস্বীকারের মনোভাবে আছে। শুরু থেকে সেটা করা হলে তো আইএমএফের কাছে যেতো হতো না। তার প্রধান কারণ হলো দেশের ভেতরে যদি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা না থাকে, কারো কাছে উত্তর দিতে না হয়, শেষ বিচারে এটার ফলাফল রাজনৈতিকভাবে দিতে হয়।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুদিন ধরে অর্থনীতিতে নানারকম যে নীতি নেয়া হয়েছে, তার ফলে আস্তে আস্তে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল। কোভিডের সময় সেসব ঝুঁকি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। এরপর সেটা সমাধানের কোন উদ্যোগ না নেয়ায় ক্রমাগত বেড়ে এখন বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে।

বিশেষ করে কঠোর নীতির অভাবে ব্যাংকিং খাত নাজুক হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে। নিয়মনীতি না মেনে কিছু গোষ্ঠীর কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, ফলে পুরো ব্যাংকিং খাতে চরম অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়েছে। অনিয়ম দেখার পরেও এক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ডলার সংকটের কারণে একদিকে যেমন রিজার্ভ কমতে শুরু করে, পাশাপাশি কড়াকড়ির কারণে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রফতানি খাতে। আবার রফতানি করা হলেও সেই অনুযায়ী ডলার দেশে না এসে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা শনাক্ত করেও কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর নামে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, কোনরকম অনুমতি না নিয়েই তারা বিদেশে অর্থ সরিয়ে নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। অর্থ পাচারের অভিযোগও উঠেছে অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে। কিন্তু কারো বিরুদ্ধেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার উদাহরণ নেই।

অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ বলেন, সবকিছুই এড়ানো সম্ভব ছিল, যদি কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হতো। এর কোন কিছুই ইউক্রেন যুদ্ধ বা বাইরের কারণে ঘটেনি। তার সাথে যুক্ত হয়েছে অব্যবস্থাপনা এবং শৃঙ্খলাহীনতা।

কর আদায়ের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র আফগানিস্তানের ওপরে রয়েছে বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আমদানি কমে গেলেও পরের বছর প্রায় দ্বিগুণ পণ্য আমদানি হয়। কিন্তু সেই সময় এটি নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে আরো দীর্ঘ হয়েছে। সেই সময়েও ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপরে ছেড়ে দেয়া হয়নি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অনেক দেশ ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেও বাংলাদেশে পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ঋণের সুদহারও বাজারের ওপরে ছাড়া হয়নি। এমনকি বিশ্ববাজারে চড়া দামে পণ্য আমদানির সময় যেমন নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, আবার বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ার পর সেটি স্থানীয় বাজারে সমন্বয় করতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে ভুল বার্তা গেছে। একটি বিশেষ চক্র এর সুবিধা নিয়েছে।

অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ বলেন, অর্থনীতিতে একটা দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন অ্যাকশন নেয়া হয়নি। ডলার পাচার হয়েছে, কোন অনুসন্ধান করা হয়নি বা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর নানা দেশে বড় বড় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে আসল ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায়ই এতদিনে হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিশেষ কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং আইনি নানা পদক্ষেপে গোষ্ঠীতন্ত্রগুলো নানা সুবিধা পাচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির আজ এই যে নাজুক দশা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোন চেষ্টা করা হয়নি। যেসব সমাধান করা সম্ভব ছিল, তার কিছুই করা হয়নি।

রিজার্ভ সংকট সামলাতে গত বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ঋণের আবেদন করে বাংলাদেশ। জবাবে তারা অর্থনীতিতে বেশ কিছু সংস্কার আনার শর্ত দেয়। এরপর কিছু কিছু সংস্কারের কথা বলা হলেও এখনো বড় ধরনের কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি।

অর্থনীতির ‘গতিপথ’ নিয়ে সরকার কী মনে করে
অর্থনীতির গতিপথ নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ এবং আশঙ্কা থাকলেও সরকার মনে করে, তারা ঠিক পথেই এগোচ্ছেন। বাংলাদেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বিভিন্ন সময় অর্থনীতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, তারা তাদের মতো বলছে, আমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে আছি, আমরা জানি ঘোড়া কোন দিকে যাচ্ছে। অর্থনীতি কেঁপে কেঁপে চলে, ডানে-বায়ে চলে, সবসময় একরকম চলে না। একটা বিষয় দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি যাচাই করা যাবে না। আমাদের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কম-বেশি হয় মাঝে মাঝে, মূল্যস্ফীতির সমস্যা আছে, কিন্তু এগুলো আমাদের সার্বিক গতিতে বিঘ্নিত করতে পারেনি। এখনো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি যেখানে ইতিবাচক, সেখানে অর্থনীতিকে কীভাবে আমি নেতিবাচক বলবো। আমাদের সব কিছু ঠিক আছে। খাবার পানির সাপ্লাই বাড়ছে, চালের দাম স্থিতিশীল, সড়ক-সেতু আছে, বিদ্যুৎ আছে-সব স্থিতিশীল। তাহলে কেনো খারাপ বলবো? তারা বলে বলুক, তাদের সাথে আমি বিরোধে যাবো না।