রহমত নিউজ 30 August, 2023 11:45 AM
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় ধরে প্রোপাগান্ডা ও বানোয়াট সংবাদেরও বিস্তার ঘটছে।অনেক ক্ষেত্রেই এসব সংবাদ এমনভাবে তৈরি এবং ছড়ানো হচ্ছে যাতে সামাজিক মাধ্যমের সাধারণ ব্যবহারকারীরা সহজেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
সর্বশেষ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে একটি মিথ্যা বা সাজানো তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অনুদান নিয়েছেন।এটি বানোয়াট বলে জানিয়েছেন সিঙ্গাপুরে বর্তমানে চিকিৎসাধীন মির্জা ফখরুল।
কোন দেশের জাতীয় নির্বাচন বা বিশেষ পরিস্থিতিতে সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর উদাহরণ নতুন নয়। সর্বশেষ ভারতের জাতীয় নির্বাচন বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরেও এই প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। কিন্তু প্রধান দুই রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই বিষয়টি কতটা নজরে রেখেছে?
আর্থিক সহায়তার ভুয়া চেকের ছবি
কয়েকদিন আগে সামাজিক মাধ্যমগুলোয় একটি চেকের ছবি ছড়িয়ে পড়ে,যেখানে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে ৫০ লাখ টাকার একটি চেক ইস্যু করা হয়েছে। সেখানে মির্জা ফখরুল এবং তার স্ত্রীর ছবি দিয়ে দাবি করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে তিনি বিদেশে গিয়েছেন।
সিঙ্গাপুর থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটা আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা। দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য, নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তারা পরিকল্পিতভাবে এসব করছে। তাদের কাজই মানুষের চরিত্র হনন করা। দেশের মানুষও সেটা জানে, তাদের কোন প্রোপাগান্ডাই মানুষ বিশ্বাস করে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে পুরো বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। সরকারের যে সমস্ত এজেন্সিগুলো আছে, তারা মানসিকভাবে এতোটা দুর্বল হয়ে গেছে, যে তারা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে এসব ভুয়া তথ্য ছেড়ে দিচ্ছে। এটা একটা দেশের গণতন্ত্রের জন্য, দেশের সংস্কৃতির জন্য খুব হতাশাজনক। কিন্তু এতে মানুষ বিভ্রান্ত হবে না। কারণ মানুষ তাদের নেতাদের ভালো করে চেনে। তাতে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে কোন ক্ষতি হবে না।
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেও আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলেছেন, এই চেকের ছবির ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনরকম কোন সম্পর্ক নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ভারতের ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে ব্যাপকহারে বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। সেইসময় এ ধরনের মিথ্যা তথ্য ঠেকাতে টুইটার এবং ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু কড়াকড়ি এবং যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব এবং মিথ্যা তথ্য শনাক্তে কাজ করে থাকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটেটিভ স্টাডিজের ফ্যাক্ট ওয়াচ প্রজেক্ট। ওই বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সুমন রহমান আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনের সামনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা আরো বাড়তে পারে। শুধু নির্বাচন নয়, যেকোনো ক্রাইসিস ইভেন্টে গুজব বাড়তে থাকে এবং সেটা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কারণ যারা এসব গুজব ছড়িয়ে থাকে,তারা অনেক বেশি প্রযুক্তি এবং কৌশলে দক্ষ হয়ে থাকে। নির্বাচন ঘিরে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা সারা বিশ্বেই একটা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। আমাদের ধারণা, নির্বাচন যতো এগিয়ে আসবে, এ ধরনের গুজব, মিথ্যা তথ্য বা ভুল তথ্য অনেক বেশি ছড়াতে থাকবে।
অতীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবের কারণে মানুষজকে পিটিয়ে হত্যা, পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার মতো তথ্য, ধর্মীয় সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ব্যাপকভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। এখন নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক গুজব ছড়াতে বেশি দেখা যাচ্ছে। গুজব শনাক্ত করতে কাজ করে, রিউমার স্ক্যানার নামের এমন একটি সংগঠনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যম মিলে প্রায় দেড় হাজার গুজব ছড়ানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা এরকম গুজব ছড়িয়ে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের রাজনৈতিক একটা মতাদর্শ রয়েছে। তারা সেই আদর্শ থেকে গুজব ছড়াতে শুরু করেন। এজন্য একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা অন্য দলকে, দলের নেতাদের লক্ষ্য করে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য তৈরি করে ছড়িয়ে দেন। যারা এসব দলের অনুসারী, তারাও সেগুলো বেশি বেশি করে শেয়ার করার কারণে দ্রুত এসব বানোয়াট তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়।
গুজব মোকাবেলায় রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে?
বাংলাদেশে যেভাবে পরস্পরবিরোধী মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তাতে ধারণা করা যেতে পারে, দলগুলোর সমর্থকরা পরস্পরকে পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি- উভয় দলটি কোনরকম ভুয়া তথ্যে ছড়ানোর সাথে সংশ্লিষ্টতা নেই বলছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা তো এরকম প্রোপাগান্ডায় অভ্যস্ত না। কিন্তু আমাদের মিডিয়া সেল আছে, সেখানে আমাদের লোকজন কাজ করছে। কিন্তু এ নিয়ে আমরা বেশি চিন্তিত না, এগুলো খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ মানুষ তো এগুলো বিশ্বাস করে না। আমার মনে হয় না, এতে কোন নেতিবাচক সমস্যা তৈরি হবে। এ ধরনের কোন গুজব বিএনপি ছড়ায় না, সবারই এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেছেন, বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগই নানারকম প্রোপাগান্ডা ও ভুয়া তথ্যের শিকার হচ্ছে। তাদের কথা - বিশেষ করে কিছু মানুষ বিদেশে অবস্থান করে আওয়ামী লীগের সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরেই প্রোপাগান্ডা হচ্ছে। বিদেশে কিছু সংঘবদ্ধ ব্যক্তি নানারকম ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। দল হিসাবে এবং আমাদের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা দায়িত্বরত আছেন, তারা কাজ করছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে যে, এগুলো মিথ্যা প্রোপাগান্ডা। মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে না, গুরুত্বও দেয় না। মির্জা ফখরুলের চেক বা বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর সাথে আওয়ামী লীগের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং সামাজিক মাধ্যমে তারাই আমাদের বিরুদ্ধে নগ্ন, বাজে ভাষায় প্রচারণা করছে। এগুলো তারাই করছে। এগুলো শুনতে শুনতে এবং দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নজরদারি করার জন্য উভয় দলেই বিশেষ সেল তৈরি করা হয়েছে। তারা এসব তথ্য পর্যবেক্ষণ করা, রিপোর্ট করার মতো কাজগুলো করে থাকে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনগুলোয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা আরও বাড়বে।
ড. সুমন রহমান বলছেন, আমার ধারণা এসব গুজব রটনাকারীরা এখন ওয়ার্মআপ পিরিয়ডে রয়েছে, তারা সবাই যার যার অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখছে যে, এগুলো কতটা কাজ করে। এখন বরং অনেক মডারেট পর্যায়ে আছে। কিন্তু যতই নির্বাচন এগিয়ে আসবে, সেটা আরও বাড়বে। ফলে, সামাজিক মাধ্যমে যেকোনো তথ্য দেখলেই সেটা বিশ্বাস করা বা শেয়ার করার আগে ব্যবহারকারীদের ভালোভাবে যাচাই করে দেখার জন্যও তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন।