মূল পাতা আন্তর্জাতিক উপমহাদেশ ভারতের মিয়ানমার নীতিই কি মণিপুরে ‘ব্যাকফায়ার’ করছে?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক 26 July, 2023 11:14 AM
দিন দশেক আগেই ব্যাঙ্ককে মুখোমুখি একটি বৈঠকে বসেছিলেন ভারত ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা, যেখানে দুদেশের সীমান্তে বেশ ‘অস্বস্তিকর’ একটি বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে খোলামেলা কথাবার্তা হয়েছিল। ‘মেকং-গঙ্গা কো-অপারেশন মেকানিজম’ নামে ভারত ও আসিয়ানভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের যে জোট আছে, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনের অবকাশেই আলাদা করে দেখা করেছিলেন ভারতের এস জয়শঙ্কর ও মিয়ানমারের থান সোয়ে। মণিপুর সঙ্কটে মিয়ানমারের ভূমিকা নিয়ে ভারত যে রীতিমতো অসন্তুষ্ট, ওই বৈঠকেই তা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন জয়শঙ্কর। পরে দিল্লিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের যে ‘ডিব্রিফিং’ করা হয়, তাতেও সে কথা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
মিয়ানমারের ভূখন্ড থেকে চালানো ‘মানব পাচার’ (হিউম্যান ট্র্যাফিকিং) ও মাদকের চোরাকারবার (ড্রাগ স্মাগলিং) যে মণিপুর পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলছে – ভারত সরকারের এখন এটাই মূল্যায়ন এবং এই কথাটাই সে দিন মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল। আসলে গত দু-আড়াই বছরে সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারের যে হাজার হাজার নাগরিক ভারতের মণিপুরে এসেছেন, ভারতের ওই রাজ্যটিতে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য তাদের একটা বড় ভূমিকা আছে এই কথাটা বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলার চেষ্টা করে আসছে।
সরকারি সূত্রগুলোর বক্তব্য হল, মিয়ানমারের এই শরণার্থীরা মণিপুরে এসে পাহাড়ে জায়গাজমি জবরদখল করছেন, আফিম চাষ শুরু করে মাদকের কারবার চালাচ্ছেন এবং তাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হচ্ছে। মণিপুরের কুকি উপজাতির লোকজন মিয়ানমারের চিন স্টেট থেকে আসা এই শরণার্থীদের নিজেদের ভাইবোনের মতোই দেখেন, কারণ তারা মনে করে কুকি ও চিনদের এথনিক বা জাতিগোষ্ঠীগত উৎস একই। তা ছাড়া এই কুকি ও চিনদের বেশির ভাগই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। অন্যদিকে মণিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেই জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অবশ্য এই কথাটা খাটে না – মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদেরকে হিন্দু বা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মেইতেইরা বরং বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। এই মুহুর্তে কোণঠাসা মণিপুর সরকারও আকারে-ইঙ্গিতে বহুবারই বলেছে, মণিপুরের পাহাড়ে আফিমের ক্ষেত আর মাদকের কারবারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযানের জেরেই এখন ড্রাগ মাফিয়ারা ‘পাল্টা প্রতিরোধ’ তৈরি করতে চাইছে এবং সেটা রাজ্যে সংঘাতের বড় একটা কারণ।
মণিপুরের রাজ্যপাল অনুসূয়া উইকেই পর্যন্ত দিনকয়েক আগে ইম্ফল ইস্ট জেলায় একটি ত্রাণ শিবির পরিদর্শনে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “সীমান্তের ওপার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরাই” রাজ্যের বর্তমান অস্থিরতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। পরে রাজভবন সূত্রে একটি বিবৃতি জারি করেও বলা হয়, রাজ্যপাল যা বলেছেন তা নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই বলেছেন। কিন্তু এই যে মণিপুরে ও দিল্লিতে ক্ষমতাসীন সরকার এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ হিসেবে মিয়ানমার বা সে দেশ থেকে আসা নাগরিকদের দিকে আঙুল তুলছে – সেই দাবি কতটা যথার্থ তা নিয়ে কিন্তু নানা প্রশ্নের অবকাশ আছে।
গলদ ভারতের নীতিতেই?
গত ১৯ জুলাই ‘ফরেন পলিসি’ সাময়িকীতে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান একটি নিবন্ধ লিখেছেন – যাতে তিনি বলতে চেয়েছেন ভারতের মিয়ানমার নীতিই আসলে পরোক্ষে মণিপুরে সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছে। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক জুন্টা আবার নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমারের কাছে ভারতের অস্ত্রশস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির পরিমাণ বিপুলভাবে বেড়েছে। অস্ত্র বিক্রির চুক্তি নিয়ে কথা বলতে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব গিরিধর আরামানে চলতি জুলাই মাসের গোড়ায় মিয়ানমার সফরেও গিয়েছিলেন।
মাইকেল কুগেলম্যান জানাচ্ছেন, “ভারতের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কিনেই জুন্টা মিয়ানমারের চিন স্টেটে ও সাগায়িং অঞ্চলে তীব্র দমনপীড়ন ও ক্র্যাকডাউন চালাচ্ছে – কারণ সেখানেই বিদ্রোহীদের প্রতিরোধটা সবচেয়ে তীব্র। জানুয়ারি মাসে তো তাদের ফেলা দুটো বোমা ভারতের ভেতরেও পড়েছিল। এই সেনা অভিযানের ফলেই হাজার হাজার চিন ভারতে পালিয়ে আসছেন, সীমান্ত দিয়ে মানব পাচার ও মাদকের চোরাকারবার বাড়ছে – এবং প্রকারান্তরে সেটাই মণিপুরে পরিস্থিতিকে এতটা উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে বলে তিনি যুক্তি দিয়েছেন। বস্তুত জাতিসংঘের পরিসংখ্যানেও বলা হয়েছে, ২০২১র সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের কাছে ভারতের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ভারত হয়তো এতে করে চীনের ওপর মিয়ানমারের নির্ভরতা কিছুটা কমাতে পেরেছে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেটা এমন এক সহিংসতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে যা ভারতের জন্যই বিরাট হুমকির কারণ, মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী প্রেসার গ্রুপ ‘জাস্টিন ফর মিয়ানমার’ও গত মাসে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, “দয়া করে আপনারা মিয়ানমারের জুনটার কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করুন।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষজ্ঞ, লেখক ও গবেষক এবং নিউ ইয়র্কের বার্ড কলেজের সাবেক অধ্যাপক সঞ্জীব বড়ুয়াও মনে করেন, আড়াই বছর আগে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া সেনা অভ্যুত্থানের একটা প্রভাব অবশ্যই মণিপুরে পড়ছে। মণিপুরের এই সঙ্কট পুরোপুরি আমাদেরই সৃষ্টি। আমি বিশ্বাস করি না চীন বা মিয়ানমার বাইরে থেকে কলকাঠি নেড়ে এই সঙ্কট তৈরি করেছে – তবে হ্যাঁ, মিয়ানমারে জুন্টার ক্ষমতা দখলের একটা অভিঘাত এখানেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিয়ানমারে সেনার হাতে নির্যাতিত যে হাজার হাজার নাগরিক ভারতে পালিয়ে আসছেন তারা মিজোরামে ভ্রাতৃপ্রতিম মিজোদের কাছ থেকে সাদর অভ্যর্থনা পেলেও মণিপুরে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই-রা তাদের বিদ্বেষের দৃষ্টিতেই দেখেন। এখন ভারত সরকার এদের কোনও মানবিক সাহায্যও করছে না, আবার জাতিসংঘের কোনও সংস্থাকেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কাজও করতে দিচ্ছে না। ফলে আমি মনে করি দিল্লির উপযুক্ত নীতির অভাবেই এরা আজ পর্যন্ত শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি, যেটা হলে মণিপুরের উত্তেজনা হয়তো অনেকটাই প্রশমিত হতে পারতো।
মিয়ানমারের অবস্থান কী?
ভারতের মণিপুরে গত প্রায় তিন মাস ধরে যে জাতি-সংঘাত, হত্যাযজ্ঞ আর সহিংসতা চলছে তা নিয়ে প্রতিবেশী মিয়ানমারের জুনটা বা সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। অথচ মিয়ানমার আর মণিপুরের মধ্যে প্রায় ৩৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত অনেকটাই শিথিল, সেখানে কোনও কাঁটাতারের বেড়া নেই – দু’পারের স্থানীয় মানুষের মধ্যে যাতায়াতও বেশ অবাধ। এমন কী গত সপ্তাহে ব্যাঙ্ককে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকের পরে ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করা হলেও মিয়ানমার কিন্তু নীরবই থেকেছে। তবে ভারতের মাটিতে মিয়ানমারের শরণার্থীরা যে ‘প্রবাসী মিয়ানমার সরকার’ (গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইল) গড়ে তুলেছেন, তারা ভারতে থাকা তাদের নাগরিকদের মণিপুর সঙ্কট থেকে দূরে থাকারই পরামর্শ দিচ্ছেন।
গত মাসে (২১শে জুন) মিয়ানমারের ‘প্রবাসী সরকারের’ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ভারতের ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকাকে জানিয়েছিল যে তারা মণিপুরের পরিস্থিতিকে পুরোপুরি ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলেই মনে করে। প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের মুখপাত্র উ কোয়াও সে দিন বলেছিলেন, মিয়ানমার কোনওভাবেই মণিপুর সঙ্কটে জড়াতে চায় না। বার্মিজ রেজিস্ট্যান্স ফোর্স’ বা ভারতে আসা মিয়ানমারের শরণার্থীরা যাতে কোনওভাবে মণিপুরের সঙ্কটে যুক্ত না হন, তাদের সরকার সেই পরামর্শই দেবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
মিয়ানমার লাগোয়া ভারতের আর একটি রাজ্য মিজোরামে মাসচারেকের মধ্যেই ভোট হওয়ার কথা – সেই নির্বাচনেও মিয়ানমারের নাগরিকরা যাতে কোনওভাবে না-জড়ান, তাদেরকে পই পই করে সে কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হল - মণিপুর সরকার কিন্তু স্পষ্টতই এখনও মনে করছে তাদের রাজ্যে হিংসা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে মিয়ানমার থেকে আসা সে দেশের নাগরিকদের একটা বড় ভূমিকা আছে।
সোমবার তারা একটি প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তার আগের আটচল্লিশ ঘন্টায় (অর্থাৎ ২২ ও ২৩ জুলাই) মিয়ানমার থেকে মোট ৭১৮জন নাগরিক মণিপুরে ঢুকেছেন। ‘বৈধ কাগজপত্র ছাড়া’ কীভাবে এতজন বিদেশিকে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হল, সে ব্যাপারে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের কৈফিয়তও তলব করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মণিপুর সরকার। একটি রাজ্য সরকার নিজেদের অধীনে থাকা বাহিনীকেই অনুপ্রবেশের জন্য দায়ী করছে, এই নজিরবিহীন ঘটনাই বোধহয় দেখিয়ে দেয় মণিপুর তাদের সঙ্কটের দায় মিয়ানমারের ওপর চাপানোর জন্য কতটা মরিয়া!