রহমত নিউজ ডেস্ক 23 July, 2023 09:20 AM
ঢাকা শহরের ৭৩ শতাংশ অবকাঠামো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। সরু গলির পাশে বড় বড় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও যেতে পারে না। সব মিলিয়ে ঢাকা শহর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ছয় ফুট প্রশস্ত সড়কের পাশে ভবনের নির্মাণ অনুমোদন না দেয়া, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা ও জলাধার রক্ষায় জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে চায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর বাংলামোটরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) মিলনায়তনে বিআইপির পাশাপাশি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম যৌথভাবে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা জানানো হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান।
‘নগর দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে করণীয়: প্রেক্ষিত ঢাকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মো. শাকিল আখতার। মূল প্রবন্ধে তাঁরা বলেন, ঢাকা শহরের প্রায় ৭৩ শতাংশ অবকাঠামোই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। দেশে মোট অগ্নিকাণ্ডের ১৫-১৮ শতাংশ ঘটে এই শহরে। আর ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই শহরের ৫৬ শতাংশ ভবনই ধসে পড়ার শঙ্কা আছে। এমন দুর্যোগপূর্ণ শহরের সড়কের একটি বড় অংশ মোটরচালিত যানবাহন চলাচলের জন্য ‘দুর্গম’(সরু)।
এমন আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজ শহর সিলেটের উদাহরণ টেনে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এত অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হয়েছে, এখন ভয় হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে মানুষের কষ্ট হবে। অগ্নিনিরাপত্তার অংশ হিসেবে নগরের পুকুর বাঁচাতে হবে, ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে মাঠ রক্ষা করতে হবে। উঁচু ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে ৮০ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করবে। তাঁরা যেন স্বস্তিতে বাস করতে পারেন, সে জন্য কাজ করতে হবে। ঢাকা শহর ‘দেয়ালের শহর’, সময় এসেছে শুধু নিজেদের দিকে না তাকিয়ে প্রতিবেশ ও নগরবাসীর দিকে নজর দেওয়ার। ছোট গলির পাশে দেয়াল দেওয়ায় সেখানে অ্যাম্বুলেন্সও ঢুকতে পারে না।
অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, একটি শহর বাসযোগ্য করার জন্য রাস্তা, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, জলাধার, উন্মুক্ত স্থান প্রয়োজন। ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) চিহ্নিত জলাধার, উন্মুক্ত স্থানের অনেকগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে পড়েছে। এগুলো রক্ষার জন্য ওই সব জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে জলাধার, উন্মুক্ত স্থান রক্ষা করা যাবে। ছয় ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশে বাড়ি নির্মাণ করলে সেখানে গাড়ি (ফায়ার সার্ভিসের ও অ্যাম্বুলেন্স) যেতে পারে না, ছয় ফুট রাস্তার পাশে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হবে না। এ জন্য জমির মালিকদের সিটি করপোরেশনকে রাস্তার জন্য জমি লিখে দিতে হবে, যাতে ওই ছয় ফুট রাস্তাকে ২০ ফুটে রূপান্তর করা যায়। ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানি তুলে নগরবাসীকে সরবরাহ করায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়তে পারে। ঢাকা শহরকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করতে নানা ধরনের আইন ও বিধিমালা আছে। যার অধিকাংশেরই প্রয়োগ নেই। এ সম্পর্কে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, আইন আছে, কিন্তু ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ, লোকবল নেই। তবে রাজউকের ‘দন্ত’ ও ‘নখ’ এখন কিছুটা ধারালো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন রাজউক ধরতেও পারছে, কামড়াতেও পারছে।
আলোচনায় রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, শিগগিরই ঢাকার ‘ঝুঁকি মানচিত্র’ প্রকাশ করা হবে, যাতে পেশাজীবী মানচিত্র দেখে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ভবন নির্মাণ করতে পারেন। ঢাকার নির্মাণাধীন ভবনগুলো যাতে নিয়ম মেনে হয়, সে জন্য একটি নিবন্ধন খাতা তৈরি করা হয়েছে। নিবন্ধন খাতায় রাজউকের কর্মকর্তাদের নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণাধীন ভবনটি যতবার পরিদর্শন করার কথা, ততবার পরিদর্শন করে ভবনসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ লিখে রাখবেন। এতে ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদেরও পর্যবেক্ষণ লেখা থাকবে। এতে নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ নিশ্চিত হবে বলে তিনি আশা করেন। তবে এ ব্যাপারে রাজউকের কারও গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভবনের ব্যাপারে তিনি বলেন, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভবনগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। এতে টেকসই ভবনগুলো টিকিয়ে রাখা এবং টেকসই ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানে বিআইপির সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, আশপাশের দেশগুলোতে নগর উন্নয়নের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় আছে। বঙ্গবন্ধুও সেটি শুরু করেছিলেন, কিন্তু ১৯৮৪ সালে মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে নগর পরিকল্পনাবিদদের গুরুত্ব কমানো হয়েছে বলে তিনি মত দেন। তাঁর মতে, পরিকল্পনাবিদদের কাজ করার সুযোগ দিলেই পরিকল্পিত নগর গড়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া ১৪ বছরেও ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন না হওয়ার সমালোচনা করেন তিনি।গোলটেবিল আলোচনায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, বাংলাদেশে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ এজেন্সির সিনিয়র রিপ্রেজেনটেটিভ মারি মিউরা, নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি অমিতোষ পাল প্রমুখ বক্তব্য দেন।