| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক উপমহাদেশ এবার বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জোট গড়তে বিরোধী দলগুলো ব্যাঙ্গালোরে


এবার বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জোট গড়তে বিরোধী দলগুলো ব্যাঙ্গালোরে


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     18 July, 2023     03:13 PM    


ভারতে আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গড়ে তুলতে দেশের অনেকগুলো বিরোধী দল ব্যাঙ্গালোরে তাদের দ্বিতীয় রাউন্ডের ‘ব্রেইনস্টর্মিং সেসন’ বা 'মাথা ঘামানো' শুরু করেছে। এর আগে গত মাসের ২৩ তারিখ বিহারের রাজধানী পাটনাতে জেডি (ইউ) দলের নেতা ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের ডাকে বিরোধী দলগুলো তাদের প্রথম বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। ব্যাঙ্গালোরে বিরোধী শিবিরের দু’দিনব্যাপী এই বৈঠক তারই পরবর্তী পদক্ষেপ, তবে এবারের বৈঠকের মূল আহ্বায়ক দল হল কংগ্রেস। রবিবার থেকেই বিরোধী নেতা-নেত্রীরা ব্যাঙ্গালোরে জড়ো হতে শুরু করেছেন। আজ (সোমবার) রাতে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার দেওয়া নৈশভোজের মধ্যে দিয়েই ঘরোয়াভাবে তাদের আলোচনা শুরু হয়ে যাচ্ছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সাবেক প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধীও ওই নৈশভোজে উপস্থিত থাকবেন এবং অতিথিদের আপ্যায়ন করবেন।

মঙ্গলবার এই বৈঠকে যোগ দেওয়া মোট ২৬টি দল আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসবে – যেখানে প্রস্তাবিত বিরোধী জোটের রূপরেখা এবং বিরোধী শিবিরের নির্বাচনী কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। রাজনৈতিক সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে, বৈঠকে যোগদানকারী দলগুলো যে সব নীতি ও কর্মসূচীর প্রশ্নে একমত, সেগুলোকে সংকলিত করে একটি ‘কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম’ বা ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচী’ তৈরি করার লক্ষ্যেও ব্যাঙ্গালোরে আলোচনা হবে। এই বিরোধী জোটের কী নতুন নামকরণ করা যতে পারে, সেটাও আলোচ্যসূচীতে থাকছে। এর আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে ইউপিএ জোট ছিল, সেই নাম যে আর থাকবে না তা বলাই বাহুল্য। সোমবার বৈঠকের প্রথম দিনেই সিনিয়র কংগ্রেস নেতা কে সি ভেনুগোপাল জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত এই বিরোধী জোটের প্রধান লক্ষ্য হবে “নরেন্দ্র মোদীর শাসনে দেশের যে প্রতিষ্ঠানগুলো নজিরবিহীন আক্রমণের মুখে পড়েছে সেগুলোকে এবং নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে রক্ষা করা।”

কারা আছেন, কারা নেই?
পাটনায় গত মাসের বৈঠকে মোট ১৬টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। এবারে সেটা বেড়ে ২৬ হচ্ছে বলে কংগ্রেস নেতারা সকালে ব্যাঙ্গালোরে ঘোষণা করেছেন। তবে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে মোটামুটিভাবে দুই ডজনের মতো দলকে ব্যাঙ্গালোরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই দলগুলোকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক. বিভিন্ন রাজ্যে যে সব দলের সঙ্গে কংগ্রেসের সমঝোতা আছে আর দুই. কোনও রাজ্যেই যাদের সঙ্গে কংগ্রেসের আঁতাত নেই – বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। প্রথম ক্যাটেগরিতে পড়ছে ১৬টির মতো দল, যার মধ্যে উল্লেখ্য তামিলনাডুর ডিএমকে, বিহারের জেডি (ইউ) ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল, মহারাষ্ট্রের এনসিপি (শারদ পাওয়ার) ও শিবসেনা (উদ্ধব গোষ্ঠী), পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম ও সিপিআই, ঝাড়খন্ডের জেএমএম বা কেরালার মুসলিম লীগ প্রভৃতি। দ্বিতীয় ক্যাটেগরিতে পড়ছে আরও সাতটি দল – যার মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি উল্লেখযোগ্য।

এই সবগুলো দলের প্রধান নেতারাই ব্যাঙ্গালোরে উপস্থিত থাকছেন – যাদের মধ্যে স্টালিন, মমতা ব্যানার্জি, নীতিশ কুমার, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, উদ্ধব ঠাকরে, সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজা, অখিলেশ যাদব, ফারুক আবদুল্লা বা মেহবুবা মুফতিদের পোস্টারে ব্যাঙ্গালোর ছেয়ে গেছে। মহারাষ্ট্রে এনসিপি-তে সাম্প্রতিক ভাঙনের পর ওই দলের প্রতিষ্ঠাতা শারদ পাওয়ার ব্যাঙ্গালোরে আসতে পারবেন কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল – কিন্তু পাওয়ার নিজেই আজ টুইট করে ঘোষণা করেছেন তিনি ১৮ই জুলাই যাবেন। তবে ভারতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি-বিরোধী দলকে কংগ্রেস ব্যাঙ্গালোরে আমন্ত্রণ জানায়নি। এর মধ্যে আছে যথাক্রমে ওড়িশা, অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানা রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজু জনতা দল, ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি। ফলে নবীন পট্টনায়ক, ওয়াইএসআর রেড্ডি বা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মতো মুখ্যমন্ত্রীরা ব্যাঙ্গালোরে থাকছেন না। এছাড়া উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের প্রভাবশালী দল – যথাক্রমে মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টি আর সুখবীর সিং বাদলের নেতৃত্বাধীন শিরোমণি অকালি দলও ব্যাঙ্গালোরে ডাক পায়নি।

চ্যালেঞ্জ কী, সম্ভাবনাই বা কী?
বিরোধী জোটের সামনে অবশ্যই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল - কী শর্তে তাদের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে আসন সমঝোতা হবে সেটা স্থির করা। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো যে সব রাজ্যে বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সরাসরি কংগ্রেসের সাথে, সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে একজন যৌথ বিরোধী প্রার্থীকে (কংগ্রেস) দাঁড় করানোটা তেমন কোনও সমস্যা নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে ক্ষমতাসীন তৃণমূল বিরোধী কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়ছে কিংবা কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত বিধায়ককে জেতার পর নিজেদের দলে নিয়ে আসছে – সেখানে দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হওয়া অবশ্যই কঠিন। অথবা ধরা যাক দিল্লি কিংবা পাঞ্জাবের মতো রাজ্য, সেখানেও কংগ্রেসের সঙ্গে আম আদমি পার্টির সম্পর্ক একেবারে আদায়-কাঁচকলায়। এই দুটি রাজ্য মিলে মোট ২২টির মতো লোকসভা আসন আছে, সেখানে বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে প্রতিটি আসনে একজন প্রার্থী দিতে পারে কি না, সেটাও দেখার বিষয় হবে। তবে আসন সমঝোতারও অনেক আগে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে একটি ‘কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম’ চূড়ান্ত করাই প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন বহু পর্যবেক্ষক।

‘দ্য প্রিন্টে’র রাজনৈতিক সম্পাদক ডি কে সিং যেমন উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, আপনি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির কথাই ধরুন! সামনের মাসেই সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে – এবং যেহেতু ডিসেম্বরের মধ্যেই রায় প্রত্যাশিত তাই ধরে নেওয়া যায় বিষয়টি আবার রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসবে। এখন কংগ্রেসের পক্ষে কি আদৌ ফারুক আবদুল্লা-মেহবুবা মুফতির সুরে সুর মিলিয়ে ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনার কথা বলা সম্ভব?

২০১৯ সালের নির্বাচনে দেশের মোট ২২৪টি আসনে (গরিষ্ঠতার চেয়ে মাত্র ৪৮টি কম) বিজেপি ৫০ শতাংশর বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিল – যার অর্থ হল সেগুলোতে বিরোধীরা সম্মিলিতভাবে একক প্রার্থী দিলেও বিজেপির জয় আটকাতে পারতেন না। তবে সেই নির্বাচনের সাড়ে চার বছর বাদে পরিপ্রেক্ষিত এখন অনেক বদলে গেছে বলেও বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মনে করছেন।

‘স্ক্রোল’ পোর্টালের শোয়েব ড্যানিয়েল যেমন লিখেছেন, ২০১৯র নির্বাচনটা কিন্তু পাটিগণিতের (অ্যারিথমেটিক) নির্বাচন হয়নি, ওটা হয়েছিল কেমিস্ট্রির (রসায়ন) নির্বাচন। ভোটের কয়েক মাস আগেও বিজেপির অবস্থা যথেষ্ঠ নড়বড়ে ছিল, কিন্তু নির্বাচনের মাত্র মাসদুয়েক আগে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন সব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল যা উগ্র জাতীয়তাবাদী ঢেউয়ে ভর করে নরেন্দ্র মোদীকে বিপুল জয় এনে দিয়েছিল। ফলে, ২০২৪ সালের নির্বাচনেও অঙ্কের হিসেবটাই জারি থাকে – নাকি নতুন কোনও ঢেউ এসে ভোটের রসায়নটা এলোমেলো করে দেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে বিরোধী জোট বিজেপির সামনে কত শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। সেই অজানা কেমিস্ট্রি অবশ্য এখনও বিরোধীদের হাতে নেই। কিন্তু যেটা আছে, সেই অঙ্কের জটিল হিসেবটাই আপাতত তারা ব্যাঙ্গালোরে গুছিয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


সুত্র : বিবিসি বাংলা