| |
               

মূল পাতা রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটে সহিংসতায় নিহত ১১, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ


পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটে সহিংসতায় নিহত ১১, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     09 July, 2023     08:56 AM    


ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের ভোটগ্রহণের দিন শনিবার ব্যাপক সহিংসতার ছবি উঠে এসেছে। সরকারি সূত্রগুলি উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে শনিবার নির্বাচনী সহিংসতায় মারা গেছেন অন্ততঃ ১১ জন, যদিও নির্বাচন কমিশনের হিসাবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এই সহিংসতার অনেকগুলিতেই ক্ষমতাসীন তৃণমূলকে যেভাবে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে , তা দেখে বিশ্লেষকরা মনে করছেন দলটি সম্ভবত কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে এই ভোটে। সব থেকে বেশি সহিংসতার ঘটনা সামনে এসেছে কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ, মালদা, পূর্ব বর্ধমান থেকে। এছাড়াও নদীয়া, বীরভূম, দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও সহিংসতা হয়েছে। রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করেছে, নিহতদের বেশিরভাগই তাদের দলের কর্মী। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, কংগ্রেস আর সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকদের নামও শনিবারের সহিংসতায় নিহতের তালিকায় উঠে এসেছে।

খুন, বোমাবাজির শুরু সকাল থেকেই
এদিন সকাল থেকেই রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা, বোমাবাজি, বুথ দখল হয়ে যাওয়া বা ছাপ্পা ভোট দেওয়ার খবর আসতে থাকে। কিন্তু এবারের ভোটে একেবারেই নতুন ঘটনা দেখা গেছে নানা জায়গায়, যেখানে আস্ত ব্যালট বাক্স উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া বা পুকুরে ফেলে দেয়া হয়েছে। নানা জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী-দলীয় কর্মীদের জোটবদ্ধ প্রতিরোধ-এর মুখে পড়ে মারও খেয়েছে।  ভোটগ্রহণের দিন সবথেকে বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে। প্রশাসনের সূত্রগুলি জানিয়েছে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোটের দিন দুপুর পর্যন্ত সেখানে পাঁচ জন খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসেরই তিনজন, এক কংগ্রেস কর্মী এবং এক সিপিআইএম কর্মী বলে স্থানীয় সূত্রগুলি জানাচ্ছে। ডোমকল, রানিনগর প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজিও হয়।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলি ভিডিওতে দেখাচ্ছে, রানিনগর এলাকায় হাতে কাটারি আর বোমা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, সংবাদমাধ্যমকে দেখেই তিনি উল্টোদিকে ঘুরে যান। ব্যাগ থেকে একটা বোমা বার করে তাকে ছুঁড়তেও দেখা যায়। বিকেলের দিকে ডোমকল থেকে আবারও গুলি চলার খবর পাওয়া গেছে। সহিংসতার নিরিখে এরপরেই উঠে এসেছে কোচবিহার জেলার নাম। সেখানকার প্রশাসন স্থানীয় সাংবাদিকদের সকালেই জানায়, বিজেপির এক বুথ এজেন্ট এবং এক তৃণমূল কর্মী খুন হয়েছেন, বোমার আঘাতে আহত হন এক সিপিআইএম প্রার্থী। আবার কোচবিহারের দিনহাটা জেলায় বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, দলীয় কর্মীরা বুথের বাইরে ব্যালট বাক্স নিয়ে এসে তা ভেঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেন। সেই ভিডিওতে এক বিজেপি কর্মীকে বলতে শোনা গেছে, “তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা এই বুথে ছাপ্পা ভোট দিয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা ব্যালট বাক্সগুলিকেই ধ্বংস করে দিচ্ছি।

ব্যালট বাক্স বুথ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া আর তা পুকুরের জলে অথবা নর্দমায় ফেলে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে কলকাতা লাগোয়া জ্যাংড়া, হাওড়ার অঙ্কুরহাটি, বীরভূমের খয়রাশোল সহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে। ১৯৯৩ সাল থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করে আসা বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও বিশ্লেষক এবং দ্য ওয়াল পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক অমল সরকার বলছিলেন, এ জিনিষ আমার কাছে একেবারেই নতুন। অনেক ধরনের নির্বাচনী সহিংসতা বা ভোট কারচুপি দেখেছি, কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ছাপ্পা ভোট দিয়েছে- এই অভিযোগে বিরোধীরা ভোট বাক্স নষ্ট করে দিচ্ছে, বা বাক্সের ভেতরে জল ঢেলে ব্যালট নষ্ট করে দিচ্ছে, তা আগে কখনও দেখি নি। আর টিভিতে যা সব ছবি দেখাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে যারা এগুলো করছে, তারা নিজেদের মুখ লুকোতেও আগ্রহী নয়। প্রকাশ্যেই করছে এটা।“

সহিংসতা নিয়ে কী বলছেন নির্বাচন কমিশনার?
পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনার দায়িত্ব রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। বর্তমানে যিনি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার, রাজ্যের সেই প্রাক্তন মুখ্য সচিব কাজে যোগ দেওয়ার পরের দিনই এক দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচন করার ঘোষণা করে দেন। ভোট ঘোষণার পর থেকেই তার কাজকর্ম নিয়ে বিরোধীরা, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, এমনকি কলকাতা হাইকোর্টও বারবার প্রশ্ন তুলেছে। সিনহা শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কোথাও ভোটদান আটকে গেছে, কোথাও দুষ্কৃতীরা ব্যালট বাক্স নিয়ে পালিয়ে গেছে। এই ধরনের অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে পেরেছি। আইনশৃঙ্খলা রাজ্য পুলিশের বিষয়। আমাদের কাছে খবর এলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে বলি। পুলিশ নিজের তাগিদে এফআইআর করবে। দরকারে গ্রেফতার করবে। তদন্ত করবে। আমাদের কাজ ব্যবস্থাপনা। কেউ গ্যারান্টি দিতে পারবে না, কে কাকে গুলি করে মেরে দেবে। কিন্তু ব্যবস্থার দিক থেকে বলতে পারি, আমরা সব রকম ব্যবস্থা নিয়েছি যাতে ভোটারেরা ভোট দিতে পারেন।

তবে সত্যিই কি সব ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন? কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশেই ভোটের নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৮০ হাজার কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী আনার কথা ছিল নির্বাচন কমিশনের। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য পুলিশের মধ্যে সমন্বয় করছে বিএসএফ। তারা জানাচ্ছে ৫৯ হাজার কেন্দ্রীয় এবং অন্য রাজ্য থেকে আসা বাহিনীর সদস্যদের শুধুমাত্র স্পর্শকাতর এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে, বাকি বাহিনীকে অন্যান্য ভোট কেন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই বাহিনীর একটা বড় অংশ শুক্রবার রাতে এমনকি শনিবার ভোট শুরু হওয়ার সময়েও রাজ্যে এসে পৌঁছয় নি। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা নিয়েও বিরোধী দলগুলি কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে শনিবার।

বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, পুরো রাজ্যে যেভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, সেটা মমতা ব্যানার্জী এবং রাজীব সিনহা খুব চালাকির সঙ্গে করেছেন। আমার এলাকার ৫০ শতাংশ বুথে তো কেন্দ্রীয় বাহিনী ঢোকেই নি, এমনকি রাজ্য পুলিশও ছিল না অনেক জায়গায়। আদালত বারবার বলে দিয়েছিল সিভিক পুলিশ দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করানো যাবে না, অথচ সেটাই হয়েছে।

কী বলছে তৃণমূল কংগ্রেস
তৃণমূল কংগ্রেস বলছে পুরো রাজ্যে শান্তিতে ভোট হলেও ছয়-সাতটি জেলা টার্গেট করে তাদের দলের কর্মীদের ওপরে হামলা চালিয়েছে বিরোধীরা। দলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাজ্যে ৬০ হাজারের বেশি বুথ একেবারে ঘটনা-বিহীন। কয়েকটা বুথে তৃণমূল কংগ্রেসকে টার্গেট করে কংগ্রেস, সিপিআইএম, আর বিজেপি হামলা করেছে। তার দাবী, ছয়জন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী শনিবার মারা গেছেন। এই ভোটে বিরোধীরা যে হারতে চলেছে, তার গাওনা গাওয়ার জন্য এই মৃত্যুগুলো দরকার ছিল।

অমল সরকারের কথায়, এটা ঠিক যে এবার বিরোধী দলগুলো অনেক জায়গাতেই তৃণমূল কংগ্রেসকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। কিছুটা জোর যার মুলুক তার-এর মতো ব্যাপার হয়েছে। যেখানে সাংগঠনিকভাবে বিজেপি শক্তিশালী সেখানে তারা তৃণমূলকে চাপে ফেলেছে, এমনকি কংগ্রেস বা সিপিআইএমও তাদের শক্তি দেখিয়েছে কয়েকটা জায়গায়। পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস যে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে, এরকম অনেকেই ভাবছিলেন, শনিবারের ভোটে সেই ছবি কিছুটা তো দেখা গেলই।

আগামী বছর লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল কংগ্রেসকে আদৌ কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে কী না, সেটা স্পষ্ট হবে পঞ্চায়েতের ভোট গণনার দিন, ১১ই জুলাই।