রহমত নিউজ ডেস্ক 26 June, 2023 05:03 PM
কুরবানির ঈদের আগে পশুর উর্ধ্বমূখী দামের মধ্যে এবার আগুন লেগেছে মসলার বাজারেও। বিশেষ করে গত বছরের ঈদের সাথে তুলনা করলে কিছু কিছু মসলার দাম দুই থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভালো মানের জিরা ও আদার দাম।
জিরা, আদা, রসুন
জিরার দর মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। এছাড়া রসুন, হলুদ, মরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচসহ অন্যান্য মসলার দামও চড়া। গত কয়েক মাস ধরেই মসলার বাজারে উর্ধ্বমূখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ঢাকার বনানী কাঁচাবাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বর্তমানে পাইকারি বাজারে জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮৮০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি দরে। খুচরা বাজারে প্রতি-কেজি জিরার দাম হয়ে যাচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। অথচ ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ২২শে জুন প্রতি কেজি জিরা সর্বনিম্ন ৩৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জিরার দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। দেশি ও আমদানি করা আদার পাইকারি দরও বেড়েছে কয়েক গুণ।
বর্তমানে আমদানি করা আদা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ২৮০ টাকা দরে। খুচরা বাজারে সেটি হয়ে যাচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকার মতো। দেশি আদারও বর্তমানে পাইকারি দর ৩৫০ টাকা কেজি এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজি দরে। অন্যদিকে টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এই সময়ে আমদানি করা আদা মান ভেদে কেজি-প্রতি ৬০ থেকে ১০০ টাকায় এবং দেশি আদা ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে আদার দাম তিন থেকে পাঁচগুণ বেড়েছে।
রসুনের দামও বাড়তি। আমদানি করা রসুন পাইকারি বাজারে কেজি-প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা দরে, অন্যদিকে খুচরা বাজারে দাম ধরা হয়েছে ১৮০ টাকা কেজি। দেশি রসুনের পাইকারি দর কেজি-প্রতি ১২০ টাকা এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। মান ভেদে কোন কোন রসুন ১৮০ টাকা কেজিও দাম হাঁকতে দেখা গিয়েছে। এক বছর আগে টিসিবির হিসাবে দেশি রসুন বিক্রি হয়েছিল ১১০ থেকে ১৪০ টাকায়। এবং আমদানিকৃত রসুনের দাম ছিল কেজি প্রতি ৭০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ ক্ষেত্রভেদে রসুনের দামও দ্বিগুণ বেড়েছে।
মরিচ, হলুদ ও অন্যান্য
শুকনা মরিচের ঝাল ছাড়িয়ে গিয়েছে এর দাম। ব্যবসায়ীরা জানান পাইকারি বাজারে আমদানি করা লাল মরিচ ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা কেজি দরে এবং খুচরা বাজারে লাল মরিচ ৪৫০ থেকে ৪৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে দেশি মরিচের পাইকারি দর ৩৮০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৪৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা যায়। অথচ এক বছর আগেও দেশি শুকনা মরিচ বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৭০ টাকায়। অন্যদিকে আমদানি করা শুকনা মরিচের দাম পড়তো ৩২০ থেকে ৩৬০ টাকা। এখানে মরিচের দামও বছর ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়েছে।
হলুদের দামও অনেকটা বেড়েছে। দেশি হলুদের কেজি-প্রতি পাইকারি দর ২৫০ টাকা এবং খুচরা দাম ৩০০ টাকা। অন্যদিকে আমদানি করা হলুদের পাইকারি দাম ২০০ টাকা এবং খুচরা দাম ২৩০ টাকা কেজি। গত বছরের এই সময়ে দেশি হলুদের দাম ছিল ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে এবং আমদানি করা হলুদের দাম ছিল আরও কম- ১৬০ থেকে ২৪০ টাকার মধ্যে। সে হিসেবে হলুদের দামও দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়েছে।
সেইসাথে ধনে, লবঙ্গ, দারুচিনিসহ দাম বেড়েছে বেশ কিছু মশলার। প্রতি কেজি দারুচিনি ৪৬০ থেকে ৫২০ টাকায়, লবঙ্গ ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায়, ধনে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আর টিসিবির হিসাবে বছরখানেক আগে দারুচিনি ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। লবঙ্গ ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় এবং ধনে ১৩০ থেকে ১৬০ টাকায়।
এদিকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হওয়ায় বাজারে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম অনেকটাই নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। ভারতীয় পেঁয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে। অন্যদিকে দেশি পেঁয়াজের দাম এখনও খুব একটা কমেনি। পাইকারি বাজারে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। অথচ টিসিবির হিসাবে এক বছর আগে দেশি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল। সে হিসেবে দেশি পেঁয়াজের দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। তবে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম গত বছরের চাইতে এবার কেজিতে অন্তত ১০ টাকা কমেছে।
কারণ ও প্রভাব
মসলার বাজারে এই অস্থিরতার জন্য আমদানিকারকরা ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজন মতো ঋণপত্র খুলতে না পারা এবং এ কারণে চাহিদা মতো মসলা আমদানি করতে না পারাকে দায়ী করছেন। চট্টগ্রামের এক আমদানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বড় আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারলেও মাঝারি আমদানিকারকদের ডলার সংকটের কথা বলে চাহিদা অনুসারে এলসি খুলতে দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো।প্রয়োজন মতো এলসি খুলতে না পারায় চাহিদা মতো আমদানি করা যাচ্ছে না। এজন্য দাম বেশি। এছাড়া ডলারের মান কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গিয়েছে। গত বছর এক ডলারের বিপরীতে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা খরচ হতো। এখন সেখানে আমদানিকারকদের খরচ হচ্ছে ১০০-১১০ টাকার মতো। সেইসাথে আন্তর্জাতিক বাজারেও কিছু কিছু মসলার দাম বেড়েছে। তাছাড়া সারের খরচ, পরিবহনের জ্বালানি ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় দেশীয় মসলার উৎপাদন খরচও বেড়েছে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ীরা বলছেন এবারে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ থেকে মসলা আমদানি হওয়ায় সরবরাহে টান পড়েছে।
মসলার দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে যাওয়ার কথা জানান তারা। বনানী কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, বেচা-বিক্রির অবস্থা ভালো না। ঈদের মার্কেটে এই সময় কাস্টমার সামলে কথা বলার সময় পেতাম না। এখন দেখেন মার্কেট খালি। আমরা কী করবো? মসলার দাম বেশি বলেই আমাদের বেশি রাখতে হয়। কাস্টমাররাও বাড়তি দামে কিনতে বাধ্য। আগে যে কিনতো এক কেজি, এখন সে কিনে আড়াইশ গ্রাম। যে কিনতো আড়াইশ গ্রাম সে কিনে ৫০ গ্রাম। সাধারণত কুরবানির ঈদ এলে মাংসসহ আরও নানা পদের খাবার রান্না হয়, যার জন্য ঈদকে কেন্দ্র করে মসলার চাহিদা বেড়ে যায়।
কিন্তু সব মসলার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া দুশ্চিন্তায় ফেলেছে ভোক্তাদের। বনানী বাজারে আসা ক্রেতারা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসনের সঠিক দর মনিটরিং জোরদার করা গেলে দাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
পেশায় গাড়ি চালক মো. রুবেল হোসেন বলেন, “আমি তো বড় চাকরি করি না, এরপরও প্রতিবছর কুরবানি দিতাম। এবার সেই সামর্থ্য নেই। জিনিসপত্রের এতো দাম। বাসায় যে মাংস আসবে সেটা রান্না করার মসলারও দাম বেশি। আয় তো বাড়ে নাই। হিসাব মিলাতে পারি না।”
মাংসের পাশাপাশি মসলাও যে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে এমনটা ভাবতেও পারেননি চাকুরীজীবী ফারহানা হুদা। বাধ্য হয়ে চাহিদার চেয়ে কম কিনে সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। “আগে তো চাল, ডাল, মাছ, মাংসের দাম নিয়ে টেনশন করতাম। এখন রান্নার মসলার দামও এতো বেশি। গত বছরের চাইতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ শতাংশ দাম বেশি। এজন্য আগে যেখানে ধরেন ৫০০ গ্রাম কিনতাম, সেটা এখন আড়াইশ গ্রাম কিনছি। যতোটা কম ব্যবহার করা যায়। আদা, জিরা অতিরিক্ত বেড়েছে। এতো দাম দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না।”
সূত্র : বিবিসি বাংলা