| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক চীন কি শেষ পর্যন্ত জনসংখ্যা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে?


চীন কি শেষ পর্যন্ত জনসংখ্যা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     20 June, 2023     12:36 PM    


চীনের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দেশটির সরকার যেসব জন্ম নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছিল, তার ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো এখন স্পষ্ট। দেশটিতে ১৯৬২ সালের পর ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো জনসংখ্যা কমতে শুরু করে। এ ছাড়া গত এক দশক ধরে কমছে চীনের কর্মজীবী লোকের সংখ্যাও। ফলে দেশটিকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। সমাধানের পথ খুঁজলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, চীন কি শেষ পর্যন্ত জনসংখ্যা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে? চীনের পরিসংখ্যান ব্যুরো চলতি বছরের জানুয়ারিতে জানায়, গত ৬০ বছরে প্রথমবারের মতো চীনে জনসংখ্যা কমার পাশাপাশি জন্মহারও নেমেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। একদিকে দেশটিতে কর্মজীবী লোকের সংখ্যা কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠী। ফলে পেনশন ব্যবস্থার ওপর চাপ অনেকটাই বেড়েছে। বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য চীনের ‘এক সন্তান নীতি’-কে দায়ী করা হচ্ছে। যদিও এর সাথে আর বেশ কিছু বিষয় জড়িত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিতে রাশ টানতে যে নীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল দেশটির সাধারণ মানুষের ওপর, এখন সেই নীতি বদলের চেষ্টা করা হলেও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বিগত ছয় দশকের মধ্যে গত বছর প্রথমবারের মতো চীনের জনসংখ্যা কমে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারা দেশটির জন্য সাময়িক কোনো ঘটনা নয়। ২০৩০ সালের পর জনসংখ্যা কমার এ প্রভাব বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর পড়তে যাচ্ছে। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চীনের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪০ কোটি। ২০২৩ সালে জনসংখ্যা কমেছে ৮ লাখ ৫০ হাজার। চীন ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে এক কঠোর পরিবার পরিকল্পনা নীতির সূচনা করেছিল, যা ‘লেটার, লংগার অ্যান্ড ফিউয়ার’ বা ‘এলএলএফ’ নামে পরিচিত ছিল। এই নীতির মূল কথা হলো-দেরিতে বিয়ে করো, সন্তান নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করো। এবং সন্তান নিলেও কম নাও। এটি ছিল মূলত একটি প্রচারণা, যা ১৯৭৯ সালে কার্যকর হওয়া সুপরিচিত এক-সন্তান নীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

চীনে বর্তমানে অস্বাভাবিক হারে জন্মহার কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে চীনের এই এক সন্তান নীতির মতো পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে বিশেষভাবে দায়ী করা হয়। দীর্ঘদিন এই নীতি চলমান থাকায় চীনের মানুষ এখন এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা নিজেরাই এখন জন্ম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী। ফলে ২০১৬ সালে এই নীতির পরিবর্তন হলেও মানুষ তেমন সাড়া দেয়নি। এরপর সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ২০২১ সালের জুলাইয়ে আবার তিনটি পর্যন্ত সন্তান নিতে উৎসাহী করে প্রচার শুরু করে চীনা সরকার। কিন্তু এতেও কোনো ফল মেলেনি। গত ৫০ বছরে চীনের জনমিতিতে হওয়া পরিবর্তন নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে জার্নাল অব ইউরোপিয়ান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনে। প্যারিসের ইকোল পলিটেকনিকের অধ্যাপক পলিন রসি ও গোথেনবার্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়ান জিয়াও পরিচালিত এ গবেষণায় চীনের জনমিতিতে হওয়া পরিবর্তন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে।

এ গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির কিছু বাড়তি প্রভাব রয়েছে। এটি শুধু ব্যক্তিকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণে প্রভাবিত করে না, বরং এ বিষয়ে একজনের প্রবণতা অন্যকেও প্রভাবিত করে। অর্থাৎ কোনো এক দম্পতি যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নেয়, তা তার আশপাশের অন্য দম্পতির ওপরও প্রভাব ফেলে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার ফলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো নিয়ে অধ্যাপক রসি এবং জিয়াও ১৯২৬ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী নারীদের নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এই গবেষণায় তারা এই নির্দিষ্ট দলের নারীদের গর্ভধারণের হার পরীক্ষা করেন৷ গবেষণায় দেখা যায়, এলএলএফ প্রচারণার প্রভাবে চীনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেরিতে বিয়ে করার প্রবণতা বেড়ে যায়। সেই সাথে এক সন্তান নেওয়ার পর পরবর্তী সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি সময় নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। ফলে চীনের অধিবাসীরা সে সময় থেকেই কম সন্তান নেওয়ায় উৎসাহিত হয়। এই সময়ের মধ্যেই চীনে গর্ভধারণ হার কমে যায় সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের মতে, ১৯৬৯ সালে মোট প্রজনন হার (একজন নারী তার জীবনকালে যতজন সন্তান নিতে পারে) ছিল ৬ দশমিক ২। এক দশক পর এলএলএফ প্রচারণা ও এক-সন্তান নীতি চালুর পর এই হার ২ দশমিক ৭-এ নেমে আসে।

মূলত সত্তরের দশকের গোড়ার দিকের এই এলএলএফ কর্মসূচি চীনের প্রধান জনগোষ্ঠী হানদের লক্ষ্য করে করা হয়। ফলে এ গোষ্ঠির মধ্যে প্রজনন হার ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যেসব এলাকায় হান জাতিগোষ্ঠীর আধিক্য ছিল, সেখানেই এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রচার প্রকট ছিল। ফলে স্বাভাবিক যে, এই জাতিগোষ্ঠীর ওপরই এই নীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি থাকবে। গবেষকেরা তাই, অন্য সংখ্যালঘু জাতিগুলোর তথ্য সংগ্রহ করেন, যাদের ওপর এই নীতি শিথিল ছিল। গবেষকরা দেখেন, সংস্কৃতির দিক দিয়ে যেসব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী যত বেশি হানদের কাছাকাছি, তাদের ওপর এলএলএফের প্রভাব তত বেশি।
গবেষণায় এ ধরনের প্রচারের দুটি বাড়তি প্রভাব দেখা যায়। প্রথমত, যেসব মা-বাবার সন্তান সংখ্যা কম, এক সন্তানের জন্য সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিতে তারা পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করতে পারে। এটা দেখে অন্যরাও কম সন্তান নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। দ্বিতীয়টি হলো সামাজিক সামঞ্জস্য, যার ফলে এক দম্পতির সন্তান সংখ্যা, অন্য দম্পতিকেও প্রভাবিত করে। শুধু চীনেই নয়, দক্ষিণ কোরিয়াতেও এলএলএফ প্রচারণার প্রভাব দেখা যায়। তবে চীনে এর প্রভাবটা ছিল অনেক বেশি। এক সন্তান নীতির অসুবিধাগুলো দেরিতে হলেও চীন সরকার বুঝতে পারে। আর এজন্যই দেশটির সরকার ২০১৬ সালে এক সন্তান নীতি থেকে বের হয়ে তিন সন্তান নীতি চালু করে। তবে এতেও জন্মহার সেভাবে বাড়েনি। ২০২১ সালে প্রজনন হার রেকর্ড পরিমাণ নেমে ১ দশমিক ২ শতাংশে আসে। চীনে সন্তান জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে লালন-পালন এখন এতটাই ব্যয়বহুল যে, দম্পতিরা সন্তান জন্ম দিতে ভয় পায়। অন্যরাও তা দেখে কম সন্তান নিচ্ছে। এভাবেই চীন এই চক্র থেকে আর বের হতে পারছে না।

এ পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে? তাত্ত্বিকভাবে, চীনের সামগ্রিক জনসংখ্যার একটি অংশের ওপর যদি এক সন্তান নীতির উল্টো নীতি কাজ করানো যায়, তাহলে জনগণের বেশি সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা বাড়তে পারে। এ লক্ষ্যে, চীনের নেতারা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাইভেট টিউটরিংয়ের প্রতিযোগিতাকে বন্ধ করার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে তারা একের বেশি সন্তান লালন-পালনের জন্য অর্থপ্রদান বা সুবিধা দিয়ে দম্পতিদের অধিক সন্তান নিতে উৎসাহিত করছে। কিন্তু এ বড় কঠিন কর্ম। কারণ, বহু সন্তান নীতি থেকে এক সন্তান নীতিতে আসা তুলনামূলক সহজ ছিল। তখন সরকারের হাতে ছিল বেশি সন্তান হলে বেশি ব্যয়ের মতো জুজু। সেই জুজু দেখিয়ে জনগণকে তো এক সন্তান নীতিতে অভ্যস্ত করা গেছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে চীনের নারীরা যেভাবে কর্মমুখর হয়ে উঠেছে, চীনা নারী-পুরুষেরা যে হারে সন্তান ও উচ্চব্যয়কে সমার্থক হিসেবে বিবেচনায় অভ্যস্ত হয়েছে, তাতে এখন রাতারাতি তিন সন্তান নীতিতে ফিরতে পারছে না দেশটি। নানা সুবিধা দিয়েও দম্পতিদের বেশি সন্তান নিতে ঠিক আগ্রহী করে তোলা যাচ্ছে না। ফলে চীনের জনসংখ্যা সংকট সহজে কাটবে, এমনটা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারছে না।

তথ্যসূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, রয়টার্স