রহমত নিউজ ডেস্ক 15 June, 2023 12:12 PM
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ‘নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু এবং পক্ষপাতহীন অনুষ্ঠানের জন্য ভূমিকা রাখতে’ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে সোমবার চিঠি পাঠিয়েছেন ছয়জন এমপি। একই দিন আরেক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের মানবাধিকার রেকর্ড যাচাই-বাছাই করা হয়। এ মাসের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কয়েকজন সদস্যও এরকম দাবি তুলে প্রেসিডেন্টের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে’ এবং ‘জনগণকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিতে’ উদ্যোগ নেয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এসব বক্তব্য আসছে এমন সময়, যখন বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু গত দুইটি সাধারণ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিভিন্ন মহলে। এই বছরের শেষ নাগাদ বা সামনের বছরের শুরুতে বাংলাদেশের যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, সেই সময়ের সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধীদের মধ্যে। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন কংগ্রেসম্যান বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের চিঠি সরকারের জন্য কতটা উদ্বেগের?
উদ্বেগের কারণ কতটা?
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন সময়ে বিদেশি আইন প্রণেতারা বা কূটনৈতিকরা মন্তব্য করলেও সম্প্রতি সেই প্রবণতা অনেক তীব্র হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ একাধিক দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে সারা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘’বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সেজন্য আমরা তো অবশ্যই, সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে।"
এর একমাস পরেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ছয় কংগ্রেসম্যান। কূটনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেসম্যান বা পার্লামেন্ট সদস্যদের এ ধরনের চিঠিতে তাৎক্ষণিকভাবে কোন ফলাফল দেখা না গেলেও এসব চিঠি খতিয়ে দেখার জন্য সেসব দেশের সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়। ফলে তারা নানারকম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, বাংলাদেশের সরকারের নিঃসন্দেহে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয় আছে। যদিও তারা ভাব দেখাচ্ছেন যে, এতে তাদের কিছু আসে যায় না,এরকম চিঠিই আসে। কিন্তু উদ্বেগ না থাকলে যে দৌড়ঝাঁপ আমরা দেখেছি, তা দেখা যেতো না। ছয়জন মার্কিন কংগ্রেস সদস্য বা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় এমপি হয়তো সেখানকার সরকারের কেউ নন। কিন্তু ওসব দেশের সরকার ব্যবস্থা এমন যে, পার্লামেন্ট সদস্যরা কোন বিষয়ে প্রশ্ন তুললে বা উদ্বেগ জানালে সরকার বা সংস্থা সরাসরি এড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে তাদের ওপরেও একটা চাপ তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, ‘ইউরোপীয় সমাজ বলেন বা মার্কিনীদের সমাজ বলেন, সেখানে গর্ভন্যান্সকে নীতির সাথে সম্পৃক্ত রাখে। সেখানে একটা ভয়েজও যদি যুক্তিসঙ্গত হয়, তাহলে সেটা শোনা হয়। সুতরাং বিষয়টা কতটা বস্তুনিষ্ঠ, তার ওপরে নির্ভর করে তাদের কথাগুলো রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে কতটা শোনা হবে।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কতটা আমলে নিচ্ছে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বা নেতারা দৃশ্যত এসব চিঠি বা উদ্বেগ প্রকাশকে খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না বলে বক্তব্য দিয়েছেন। মার্কিন কংগ্র্যাসম্যানদের চিঠির এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘চিঠিতে অতিরঞ্জন ও অসঙ্গতি রয়েছে। এরকম চিঠি অতীতেও এসেছে, ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে আসতে পারে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এই ধরনের কার্যক্রম তত বাড়তে থাকবে। বিদেশে কারো কাছে ধর্না দিয়ে বা কারো চাপে পড়ে বা কারো সঙ্গে সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতেই হবে- এরকম কোনও নীতির প্রতি অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশের মানুষকে পেছনে ফেলে দেওয়ার নীতিতে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে না। তবে যে মার্কিন সদস্যরা এই চিঠি পাঠিয়েছেন, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা কথা বলবেন। তাদের বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে নিয়মিত জানানো হবে।’
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর তদবিরের কারণেই বিদেশে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এসব আলোচনা বা চিঠি পাঠানো হচ্ছে। ফলে এসব বক্তব্য তারা আমলে নিতে চান না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি-জামায়াত এই সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধীদের রায় হওয়ার পর থেকেই লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারের বিরুদ্ধে নানান ধরনের মিথ্যাচার করে আসছে। যদি অর্থের বিনিময়ে কোথাও কোন ব্যক্তি বিবৃতি দেয়, সেটা নিয়ে আমাদের কি এখানে আমলে নেয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে?
আওয়ামী লীগের নেতারা যাই বলুক, এসব বক্তব্য যে তাদের মধ্যে একটা উদ্বেগ তৈরি করছে। এ কারণেই কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে নানারকম তদবির বা চেষ্টা করা হয়েছে। ভিসা কড়াকড়ি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কোন কোন নেতা। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নিরসনে বাংলাদেশের তরফ থেকে একাধিকবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, ‘বিষয়গুলো নিশ্চয়ই আমাদের জন্য চিন্তার কারণ, কারণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের যে ভাবমূর্তি আছে, এগুলো তার সাথে সম্পর্কিত, অর্থনীতির সাথেও সম্পর্কিত। যদিও নির্বাচনের এখনো ছয় থেকে সাত মাস বাকি আছে। কিন্তু তার আগে বিভিন্ন দেশ থেকে একটার পর একটা উদ্বেগ জানানো হচ্ছে, কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর ভিসা নিয়ে কড়াকড়ির মতো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, ‘এসব উদ্যোগের ফলে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে পারেন। কারণ বেশিরভাগ নিষেধাজ্ঞা আসবে ব্যক্তির ওপরে। ফলে যারাই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনায় জড়িত থাকবে, তারা খানিকটা চিন্তায় থাকবেন যে, সেখানে কোন উল্টাপাল্টা কিছু হলে তাদের সমস্যা হবে কিনা।‘
এর আগে ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে, ২০১৪ সালের পাঁচই জানুয়ারির এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন দেশের তরফ থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এবার নির্বাচনের প্রায় একবছর আগে থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের ওপর নজর থাকার কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব কারণে বাংলাদেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভের প্রকাশও করা হয়েছে।
গত এপ্রিল মাসে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই ওকালতি করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে যাতে গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে সংবিধান আছে। সংবিধান অনুযায়ী সরকার চলছে, দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এখানে কে কী চাইলো, কোথায় আপত্তি করলো, তা তো আমাদের দেখার বিষয় না। আর আমাদের দেশের বিষয়ে বাইরের লোকজন কেন কথা বলবে? তারা যদি কিছু বলেও, সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কোন দরকার দেখি না।’
আবারো শান্তিরক্ষী বাহিনী ইস্যু?
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সোমবার জাতিসংঘের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে আহ্বান জানিয়েছে, বাংলাদেশে থেকে যাদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নেয়া হয়, তাদের নিয়োগের পূর্বে যেন মানবাধিকারের বিষয়গুলো যাচাই করা হয়। বিরোধী দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহমেদ যখন ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে একরোখা ছিলেন, সেই সময়েও এমন একটি বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছিল যে, জাতিসংঘে শান্তি রক্ষী নিয়োগ ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করছে জাতিসংঘ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০০৭ সালের সেই ঘটনাকে মনে রেখেই হয়তো শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা তৈরি হচ্ছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, এই ক্ষেত্রে অবশ্য কোন বিবৃতি খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারে না। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যারা অংশগ্রহণ করে, এমনিতেই তাদের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ একটা স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা করে। যেমন মানবাধিকার ইস্যু, নারী বিদ্বেষী হলে বা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আছে কিনা, সেটার এক ধরনের যাচাই করা হয়। হয়তো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই কথাটা আমরা আগে শুনিনি বলে আমাদের কাছে নতুন বলে মনে হচ্ছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, ২০০৭ সালের তুলনায় এবারের পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা বলে তাদের মনে হচ্ছে। কারণ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, এটা বাংলাদেশের জন্য নতুন। ফলে সরকার স্বীকার না করলেও তাদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু এবার আর সেই রকম কোন সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ।তিনি বলেন ২০০৭ সালের প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ওই সময় বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতা আটকে রেখে সংবিধান লঙ্ঘন করে অসাংবিধানিক পন্থায় গিয়েছিল, ফলে একটা সাংবিধানিক সংকটের তৈরি হয়েছিল। সেই কারণেই আমরা দেখেছিলাম, সামরিক সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছিল, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে খুব বেশি সুফল আসেনি, অনেক বিতর্ক সৃষ্ট হয়েছিল। এটা একবার এই বাংলাদেশে ঘটে গেছে, দ্বিতীয়বার এই বাংলাদেশে ঘটার কোন সম্ভাবনা আছে বলে আমরা মনে করি না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ আর সেই ধরনের সরকার দেখতে চায় না। বাংলাদেশের মানুষ যেটা চায় না, সেটা অন্য কেউ জোর করে চাপিয়ে দিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বা কোন ফল আসবে না।
মঙ্গলবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘’এখন আবার বিদেশি শক্তিকে দিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের মতো দুই বছরের জন্য নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক একটা বসাবে। আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ললিপপ খাব? কেমনে এটা মনে করলেন? সব খবর আমরা রাখি। কোথায় কোথায় ষড়যন্ত্র হচ্ছে? ওয়ান-ইলেভেনের দুঃস্বপ্ন দেখে আর লাভ নেই।‘’
লবিংয়ের দাবি কতটা যৌক্তিক?
সরকারি দলের নেতারা দাবি করছেন, লবিং করার মাধ্যমে বা অর্থের বিনিময়ে তদবির করার কারণেই মার্কিন বা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট থেকে এসব বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘এটা প্রচলিত আছে, পশ্চিমা দেশের অনেক দেশের পার্লামেন্ট মেম্বারদের অনেককেই অর্থ দিলে, যে অর্থ দেয় তার পক্ষে কথা বলে। লবিস্ট নিয়োগ করে। লবিস্টদের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে অনেকে কথা বলে।
তবে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, এসব বিবৃতির পেছনে লবিং করা হয়েছে কিনা তার জানা নেই। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোয় লবিং নতুন কিছু নয়। আমি যতটুকু জানি, যুক্তরাষ্ট্রে লবিং খুব সাধারণ একটা বিষয়। সেখানে লবিংয়ের মাধ্যমেই অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু কোন কারণে যদি লবিংয়ের কারণেও এসব চিঠি লেখা হয়ে থাকে, সেটারও কিন্তু একটা প্রভাব থাকবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে অনেক সিদ্ধান্তই লবিংয়ের কারণে নেয়া হয়ে থাকে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির অবশ্য বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে যেমন লবিং করা হয়ে থাকে, অনেক সময় কংগ্রেসের সদস্যরা নিজে থেকেই বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তাদের নিজস্ব গবেষণা থাকে। বিভিন্ন দেশ সম্পর্কিত স্বার্থের ব্যাপার থাকে। লবিং যেমন হয়, অনেক সময় নিজেদের গবেষণা থেকেও তারা বক্তব্য বা চিঠি দিতে পারেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন বা রাজনীতি ঘিরে বিদেশী পার্লামেন্ট বা সংসদীয় কমিটির উদ্বেগ প্রকাশ এবারই প্রথম নয়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা জানতে চেয়ে ২০১৯ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল মার্কিন কংগ্রেসের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি।
ওয়াশিংটনে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, এখানে লবিং হয়েছে কিনা, কারা লবিং করেছে, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, সেখানে যেসব বক্তব্য তোলা হয়েছে, সেসবের বাস্তবতা কতটা রয়েছে। আমি জানি না, এখানে কি হয়েছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের ভালো কাজের জন্য যেমন বাহবা পাই, তেমনি তারা কেন এসব অভিযোগ তুলছে, আমাদের কোন ঘাটতি আছে কিনা, সেটাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার। সেসব কারণ যদি আমরা মিটিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে এখানেও কিন্তু বাহবা পেতে পারি। লবিংয়ের কারণেই তারা বড় ব্যবস্থা নেবে, সেটা মনে করা হলে সরলীকরণ করা হয়ে যাবে। আবার তারা ব্যবস্থা নিলে কিছু হবে না, সেটা ভাবাও ভুল। আমি বলবো, বিষয়গুলোর বস্তুনিষ্ঠতার দিকে মনোযোগী হলে এ ধরনের জটিলতার বাইরে থাকা যাবে। আর আমরা যদি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাই, অন্যরা করেছে উস্কানি দিয়ে, তাহলে যে কারণে সমস্যাটা হয়েছে, সেটাকে যথাযথভাবে অ্যাড্রেস করতে পারবো না।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
বিএনপি অর্থের বিনিময়ে লবিং করিয়ে কংগ্রেসম্যান বা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের বক্তব্য বা বিবৃতি আদায় করছে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা যেসব অভিযোগ করেছেন, তা নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির তো অভিযোগ করার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ এখন গ্লোবাল স্ক্যানারের নিচে রয়েছে। বাংলাদেশে কী হচ্ছে সেটা সবাই দেখছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, গুম, খুন, ভোটের অধিকার না থাকা- এগুলো নিয়ে সারা বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে, দূতাবাসগুলো থেকে রিপোর্ট যাচ্ছে। এখানে তো বিএনপির লবিং করার দরকার হয় না। বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর আইনপ্রণেতারা স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর সাথে বিএনপির কোন সম্পৃক্ততা নেই। যারা এসব বিবৃতি দিয়েছে, তাদের দেশে একটা পার্লামেন্টারি প্রাকটিস আছে। তারা সারা বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে নজর রাখেন। এখানে যে গুম, খুন হচ্ছে, গণতন্ত্র নেই, বাক স্বাধীনতা নেই, ভোটের স্বাধীনতা নেই, এসব নিয়ে বিশ্ব জুড়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তারই প্রতিফলন হিসাবে এসব বক্তব্য বিবৃতি আসছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা