সাইফ সিরাজ 25 May, 2023 08:02 PM
বাংলা সাহিত্যে লেখকদের নাম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকাংশ লেখকই লেখা শুরু করার পর পিতৃপ্রদত্ত নাম বদলে নিজের পছন্দমতো নাম গ্রহণ করেন। কেউ আবার সনদপত্রের নামে পরিচিত থাকার পরেও ছদ্মনামে লেখেন। বিসিএস ও চাকুরির পরীক্ষায় এই নামের প্রশ্ন সব সময়ই চাকরিপ্রার্থীকে বিব্রত করে। ফলে লেখকদের নাম নিয়ে বিসিএসপ্রার্থীদের আলাদা প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। এ তো গেল একাডেমিক হালত। পত্রিকা, প্রকাশক আর ব্যানারেও চলে নাম নিয়ে নানান তেলেসমাতি কায়কারবার।
কখনো লেখকদের নামের বানান নিয়ে। কখনো অন্য জনপ্রিয় লেখকের নামের সঙ্গে মিলে যাওয়া। কখনো নামের অংশ নিয়ে চলতেই থাকে কোনো-না-কোনো ক্যাচাল। এসব ক্যাচাল কখনো কখনো পত্রিকার অফিস থেকে সাহিত্য আড্ডা হয়ে ব্লক ফেসবুকের ভাইরাল টপিক পর্যন্ত হয়ে ওঠে। মন্তব্য পালটা মন্তব্য কিংবা যুক্তি-প্রতিযুক্তির ভেতর দিয়ে আলাপ চলতে চলতে কখনো কখনো থলের বেড়াল বের হয়ে আসে। বের হয় কারও কারও মানসিক নীচতাও।
নামের বানান নিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা বিতর্ক তৈরি ও স্বেচ্ছাচার করেছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে বাংলাদেশি লেখক, খেলোয়াড় ও রাজনীতিকের নামের বানানে তারা প্রায় সময়েই ভুল করেছে। কখনো আবার ভারতীয়দের নামেও করে। কারও কারও মতে এটা আনন্দবাজারের স্বেচ্ছাচার। কেউ বলেন অবহেলা। কেউ বলেন পরিকল্পিত ডিহিউমেনাইজ করা। আবার আনন্দবাজারের পক্ষে কেউ যুক্তি দেখান, তারা মৌলিকভাবে হিন্দি থেকে নামগুলোর উচ্চারণ গ্রহণ করেন—ফলে এমন হয়। অন্তত বাংলাদেশীদের জন্য এই যুক্তি প্রচণ্ড হাস্যকর। কারও মতে নিজস্ব বানানরীতির কারণে এমনটা হয়। এই যুক্তিও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বহুদিন আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ি না। ফলে এই মুক্ত ডেটার যুগে তারা কী করছেন বাংলাদেশী লেখকদের নামের বানান নিয়ে, তা আর দেখা হচ্ছে না। যারা পড়েন, তাদের মতে স্বেচ্ছাচার অনেকটাই কমেছে। তবে মাঝেমধ্যেই তাদের সেই নিজস্বতার ব্যারাম না কি এখনো চলতে থাকে। যেমন : ভারতের ক্রিকেটার বীরেন্দর শেবাগ/শেওয়াগ/শেহওয়াগ (এই তিনটি বানানই আমি দেখেছি বাংলায়।)-এর নাম আনন্দবাজার লেখে ‘সহবাগ’।
দুই হাজার সাত সালে সামহোয়্যারইন ব্লগে আনন্দবাজারের এই নামকাণ্ড নিয়ে একটা ব্লগ আসে। সেই সূত্র ধরে ‘গুরুচণ্ডালি’ নামক আরেক ব্লগ সাইটে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যে নামের বানান নিয়ে আলাপ জমে উঠেছিল তখন।
এই লেখা যখন লিখছি—অনেক খুঁজে পেয়েছি সামহোয়্যারইনের ব্লগটি। ব্লগার হাসিবের লেখা ব্লগটির নাম ছিল ‘আনন্দবাজারীয়দের সমস্যাটা আসলে কোথায়’। সেই ব্লগের সূত্রে হওয়া ‘গুরুচণ্ডালি’ ব্লগের আলোচনাটার লিঙ্ক আর পাইনি। সেই লিঙ্কের সূত্রে ক্লিক করলে সাইটটি বলছে ‘দুঃখিত’।
হাসিব লিখেছেন, ‘মেজাজটা বিগড়ানো শুরু হলো তখনই যখন বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নামগুলো দেখলাম। একটা লিস্ট দেই দেখেন।
তামিন ইকবাল
মোশারফ মোর্তাজা
আব্দুর রজ্জাক
জাভেদ ওমর
এখানে একমাত্র জাভেদ ওমরের নামটা ঠিক আছে। বিদেশীদের নাম লেখায় ওদের বানানরীতি কিছুটা উদ্ভটই মনে হয় আমার কাছে। যেমন, ভেট্টোরীকে ওরা লেখে ভেত্তোরী। তা সেটা তারা লিখতেই পারে। হাজার হোক ভেট্টোরী তার নামের বানানটা বাংলাটা কি হবে সেটার নির্দেশনা কোথাও দেননি বলেই আমার ধারনা। কিন্তু বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের নামের বানানটা কি হবে সেটা তো আমাদের যেকোন পত্রিকার সাইট খুললেই দেখা যায়। এখানে দুটো সম্ভাবনা হতে পারে, এক তারা বাংলাদেশের কোন নিউজপেপারের থোড়াই কেয়ার করে। অথবা বাঙালদের কোন নিউজপেপার ইন্টারনেটে আছে বলেই তারা জানে না। কোনটা সত্য ওরাই বলতে পারবে।’
সেই পোস্টের কমেন্টে অতিথি নামের একজন ব্লগার মন্তব্য করেন। সেটা আরও বিব্রতকর। তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশীদের নামের বানান নিয়ে ওদের এই হীনমন্যতা ইচ্ছাকৃত। অনেক পরিচিত নাম তারা মানসিক দৈন্যতা থেকে লিখে থাকে। আমি কলকাতায় থাকা অবস্থায় যে নামগুলো দেখেছিলাম তা হলো।
সৈকত অসমান
অকতারুজামান এলিয়াস
তানবির মকাম্মল
সামছুর রহামান
হুমাঅন আহমদ
কলকাতার দাদারা আমাদের নামের বানান লিখার সময় একেবারেই ছোটলোকি মানসিকতা ধারণ করে। অথচ আমরা সুনীল কিংবা শীর্ষেন্দু কিংবা সমরেশের নামের বানান ভুল করি না।’
ভাবা যায়! বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক শওকত ওসমানের নাম ‘সৈকত অসমান’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম ‘অকতারুজামান এলিয়াস’, চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের নাম ‘তানবির মকাম্মল’, শামসুর রাহমানের নাম ‘সামছুর রহামান’ এবং হুমায়ূন আহমেদের নাম ‘হুমাঅন আহমদ’ লেখার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে! অন্যকে ছোট করে দেখা কিংবা অবহেলা করার পলিটিক্স ছাড়া এটা আর কী হতে পারে! অপরদিকে শমী কায়সারকে দীর্ঘদিন ‘শমি কাইজার’ লিখে গেছে তাদের টিভি চ্যানেল। এটা কোন ধরনের ভদ্রতা বা সংস্কৃতি, তা আমাদের জানা নেই। সেই পোস্টে অন্য একজন মন্তব্য করেছেন, “এটা আরো অনেকদিন থাকবে, ওমর কায়সারকে ‘ভ্রমর কায়সার’ লিখার চল।” এরচেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে!
দুই হাজার পনেরো সালের দিকে সাংবাদিক ও কবি জুয়েল মাজহার আনন্দবাজারের এই নামের বানান নিয়ে আরেকটি লেখা লিখেছিলেন। সেটা নিয়েও বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তার আগের আইডি না থাকায় সেই বিতর্কটি হারিয়ে গেছে। অপরদিকে ওরা পাকিস্তানের বিখ্যাত ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরামকে ‘অসীম আক্রম’ লিখতে দেখেছি। সাঈদ আনোয়ারকে ‘সইদ’ এখনো লেখে। এরা শুধু তামিম ইকবালকে ‘তামিন ইকবাল’, মাশরাফি মোর্তজাকে ‘মোশারফ মোর্তজা’, আব্দুর রাজ্জাককে ‘আব্দুর রজ্জাক’, শওকত ওসমানের নাম ‘সৈকত অসমান’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম ‘অকতারুজামান এলিয়াস’, চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের নাম ‘তানবির মকাম্মল’, শামসুর রাহমানের নাম ‘সামছুর রহামান’ এবং হুমায়ূন আহমেদের নাম ‘হুমাঅন আহমদ’ লিখেই থামেনি। মাহমুদুল্লাহকে ‘মামুদুল্লা’ও লিখেছে। বিখ্যাত রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম ‘সুরাবর্দী’ পর্যন্ত লিখেছে এরা।
২০২০ সালের ২৪ জুন প্রভাষ আমীন বাংলা ট্রিবিউনের এক কলামে লেখেন, “আনন্দবাজার শুধু ভারতের নয়, এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা। একসময় বাংলা ভাষার শিল্প, সাহিত্য, লাইফস্টাইল, মানুষের রুচি তৈরির অনেকটা কৃতিত্বই ছিল এই গ্রুপের অন্য প্রকাশনাগুলোর। এখন প্রকাশনা বন্ধ থাকলেও দেশ, সানন্দা সমান জনপ্রিয় ছিল বাংলাদেশেও। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব তাদের চিরদিনের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবিদের নাম তারা বারবার ভুল ছাপে।
আমার ধারণা এটা তারা ইচ্ছা করেই করে। ইচ্ছা করেই করে, এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ আনন্দবাজারে চাইলেই যে কেউ যা ইচ্ছা লিখতে পারবেন না। তাদের নিজস্ব বানান রীতি আছে। বানানের ব্যাপারে যারা এতো সচেতন, তারা সম্মানিত মানুষদের নাম দিনের পর দিন ভুল ছাপবে, এটা হতে পারে না। তারা ইচ্ছা করেই বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষদের হেয় করার জন্য, অপমান করার জন্য ছাপে। একজন মানুষের নামের বানান তিনি যেভাবে লিখতে চাইবেন, সেটাই সঠিক। সাধারণত বাংলাদেশের অনেক মানুষের নামের সঙ্গে ‘রহমান’ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান কবির নাম শামসুর রাহমান, একজন সম্পাদকের নাম শফিক রেহমান। এখন আমার ইচ্ছা হলেই তাদের শামসুর রহমান এবং শফিক রহমান বানাতে পারবো না। আনন্দবাজার এটা যখন তখন করে। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম আনন্দবাজার দিনের পর দিন ‘সুরাবর্দী’ লিখে গেছে। ইদানীং কলকাতায় জনপ্রিয় বাংলাদেশের জয়া আহসানের নাম তারা লেখে জয়া এহসান। আমি নিশ্চিত তার নাম যদি সত্যি জয়া এহসান হতো, তাহলে আনন্দবাজার জয় আহসান লিখতো। বাংলাদেশের ক্রিকেটার মাহমুদুল্লাহকে তারা লেখে মামুদুল্লা। এগুলো ভুল নয়, নিজস্বতা নয়; স্রেফ বিকৃতি। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষদের হেয় করার চেষ্টা।”
নামের ক্ষেত্রে আনন্দবাজারের এই বিষয়টাকে আমি দেখি অন্য একটা দৃষ্টিতে। কলকাতার বাংলা ক্রমশ হিন্দির অগ্রাসনে আবেদন হারাচ্ছে। আনন্দবাজার কলকাতার সবচেয়ে পুরনো এবং অভিজাত একটা পত্রিকা। তাদের এসব ঐতিহ্য এবং প্রভাব তাদের মধ্যে একটা সুপিরিয়রিটির জন্ম দিয়েছে। সেই সুপিরিয়র কমপ্লেক্স রক্ষা করার মনোবাসনা থেকেই অবচেতনে একটা ইনফিরিয়র কমপ্লেক্সে ঢুকে গেছে। ফলে নিজেদের ডমিনেটিং বা প্রভাবশালী রাখতে গিয়ে নিজেদের একটা ক্ষমতার চর্চা হিসেবে এবং বাংলাদেশের সাহিত্য, রাজনীতি ও কালচারের প্রতি তাদের অবহেলাটা প্রকাশ করতে গিয়ে এমনটা করে থাকে।ওদিকে বাংলাদেশে প্রথম আলো করেছে আরেক নীতি। কোনো লেখকের নামের তিনটি অংশ থাকলে তারা শেষেরটাকে ডাকনাম ধরে নেবে। আর ডাকনাম ফেলে দিয়ে লেখকদের নাম পত্রিকায় ছাপবে। তাদের এই নীতি অবশ্য একটু বড় কোনো লেখকের জন্য প্রযোজ্য হয় না। যেমন : ইমদাদুল হক মিলন-এর নামের ক্ষেত্রে মিলন তারা কখনোই ফেলে দেয় না। ডাকনাম। নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য পাড়ায় আছে আরও মজার মজার ব্যাপার। সামনের কিস্তিতে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার এরাদা রেখে আজকের কিস্তি শেষ করছি।
লেখক : কবি ও বিশ্লেষক