| |
               

মূল পাতা ইসলাম শ্রমিকের অধিকার


শ্রমিকের অধিকার


আ.স.ম আল আমিন      01 May, 2023     08:38 PM    


ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা আল্লাহর, আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং এখানে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-স্নেহ, সৌহার্দ ও বিশ্বস্ততায় ভরপুর। শ্রমিক ও মালিক উভয়ের অধিকার রয়েছে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার। উভয়কে বলা হয়েছে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক বা শুধু শ্রমিক নয়; বরং উভয়কে সুসংহত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। 

শ্রমিকের গুরুত্ব : মানবতার ধর্ম ইসলাম যেমন শ্রমের মর্যাদা দিয়েছে, তেমনি শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়েছে। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ পূর্ণ করা হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো; আর আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।’ (সুরা জুমুআ : ১০) কুরআনে আরও এরশাদ হয়েছে- ‘সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত-সমর্থ্য ও আমানতদার। (সূরা কাসাস : ২৬) হাদিসে এসেছে রাসূল সা:তাঁর মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও অধীনস্থ শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছেন, ‘হে আমার উম্মতরা! তোমরা অধীনস্থদের অধিকারের ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকো (কখনও তাদের ওপর জুলুম করো না)।’ (আবু দাউদ : ৫১৫৬)। ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা অপরিসীম। রাসুল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ রশি নিয়ে পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে তা বাজারে বিক্রি করে জীবনযাপন করা এটা তার জন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করার চেয়ে উত্তম, চাই তারা দিক বা না দিক।’ (বুখারি : ১৪৭১)

মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক : রাসূল সা: বলেছেন, ‘তারা (অধীনস্থ ব্যক্তিবর্গ) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। আল্লাহ তাআলা (দ্বীনী) ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিলে সে যা খাবে তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে তাকে তা পরিধান করতে দিবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত তা করার জন্যে তাকে বাধ্য করবে না। আর সেই কাজ যদি তারদ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে। (আল হাদিস)। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না; যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’-(সুরা নাহল: ৭১)। 

শ্রমিকের প্রাপ্ত মজুরির অধিকার : রাসূল সা: বলেন, তোমরা ঘাম শুকানোর আগে শ্রমিককে তার মজুরি দিয়ে দাও।( ইবনে মাজাহ:২৪৪৩) অন্য হাদিসে রাসূল সা: বলেন, আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। অপর ব্যক্তি, যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করেও তার পারিশ্রমিক দেয় না।( বুখারি: ২২২৭) এছাড়া মজুরি সম্পর্কে কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে । আল্লাহ তায়ালা বলেন,বল, ‘আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাইনি, বরং তা তোমাদেরই। আমার প্রতিদান তো কেবল আল্লাহর নিকট এবং তিনি সব কিছুর উপরই সাক্ষী। (সূরা সাবা:৪৭) অন্য আয়াতে বলেন, অতঃপর নারীদ্বয়ের একজন লাজুকভাবে হেঁটে তার কাছে এসে বলল যে, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যেন তিনি আপনাকে পারিশ্রমিক দিতে পারেন, আমাদের পশুগুলোকে আপনি যে পানি পান করিয়েছেন তার বিনিময়ে’। অতঃপর যখন মূসা তার নিকট আসল এবং সকল ঘটনা তার কাছে খুলে বলল, তখন সে বলল, ‘তুমি ভয় করো না। তুমি যালিম কওম থেকে রেহাই পেয়ে গেছ’। (সূরা কাসাস:২৫)

শ্রমিককে ভালোবাসা : আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপট খুবই ভিন্ন আমরা কোন শ্রমিককে কাজের জন্য নির্ধারন করলে তাকে কোন ধরনের সহযোগিতা করিনা বরং তাকে দিয়ে সকল কাজ করানোর চেস্টা করি । তবে এক্ষেত্রে রাসূল সা: ছিলেন ব্যতিক্রম তিনি শ্রমকে ভালোবাসতেন। তিনি নিজ হাতে জুতা মেরামত করেছেন, কাপড়ে তালি লাগিয়েছেন, মাঠে মেষ চরিয়েছেন। নবীজী (সা.) ব্যবসা পরিচালনাও করেছেন। খন্দকের যুদ্ধে নিজ হাতে পরিখা খনন করে শ্রমের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘শ্রমিক আল্লাহর বন্ধু।’ (অfল হাদিস) রাসূল সা: এ ব্যাপারে আরও বলেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.) নিজের হাতে কাজ করে খেতেন। (সহিহ বোখারি)

শ্রমিকের সাথে উত্তম ব্যবহার করা : আমরা যখন কোন শ্রমিককে কাজে নিয়োগ দেয় , কম সংখ্যক লোক তাদের সাথে বালো ব্যবহার করে বেশিরভাগেই খারাপ ব্যবহার করে , আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী । (সূরা নিসা: ৩৬) হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হযরত আবূ হোরায়রা রা.থেকে বর্ণিত , রাসূল সা:তোমাদের কারো খাদেম তার নিকট খাবার নিয়ে আসলে তাকেও নিজের সাথে বসানো উচিত। যদি তাকে একত্রে না বসাও তবে অন্ততঃ দুই এক লোকমা খাবার তার মুখে তুলে দেওয়া উচিত। কেননা সে এই খাবার (পরিবেশন) এর জন্য পরিশ্রম করেছে। (বুখারি: ২৩৮৮)।

শ্রমিকের সাথে খারাপ আচরণ না করা : পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ ইচ্ছে করলে তুমি আমাকে সদাচারী পাবে। (সূরা কাসাস:২৭) রাসূল সা: কখনো নিজ খাদেম হযরত আনাস রা.কে ধমক দেননি এবং কখনও কোনো প্রকার কটূবাক্য ও কৈফিয়ত তলব করেননি। এ সম্পর্কে হযরত আনাস রা. নিজেই বলেন, ‘আমি দশ বছর যাবৎ আল্লাহর রাসুল সা:এর খেদমত করেছি। তিনি আমার সম্পর্কে কখনো উহ! শব্দটি বলেননি এবং কখনও বলেননি, এটা করোনি কেন? এটা করেছো কেন? আমার অনেক কাজ তিনি নিজ হাতে করে দিতেন।’ (সহিহ বোখারি)আরেক হাদিসে এসেছে, হযরত আবুবকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, “অধীনস্তদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সা: মালিকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন কর্মচারী, শ্রমিক ও অধীনদের সাথে সন্তান-সন্তুতির ন্যায় আচরণ করে এবং তাদের মান-সম্মানের কথা স্মরণ রাখে। রাসূল সা: আরো বলেন, “তাদের এভাবে সম্মান করবে যেভাবে নিজের সন্তানদের কারো এবং তাদেরকে সে খাবার দিবে যা তোমারা নিজেরা খাও।”

শ্রমিকের ওয়াদা পূরণ করা : আমরা অনেক সময় শ্রমিকের সাথে যে চুক্তি করি , তা ঠিক মতে দেইনা। বরং না দিয়ে তাদের সাথে গালমন্দ করি , তা হয়তো মজুরি বা কাজ নিয়ে । আল্লাহ তায়ালা বলেন,হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ কর। ( সূরা মায়েদা:১) হাদিসে ইরশাদ হয়েছে ,রাসুল সা: বলেন, “ ধনী ব্যক্তির (পক্ষ থেকে কাহারো পাওনা প্রদানে ) টাল-বাহনা করা জুলুম আর যখন তোমাদেরকে কোনো আদায় করতে সক্ষম ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত করা হয় , তখন সে যেন তার অনুসরণ করে” (মুসিলম: ১৫৬৪)

ফরজ ইবাদত পালনে স্বাধীনতা দেয়া : ইসলামিক মাইন্ডের লোক ছাড়া খুব কম লোকই এই বিষয়টির প্রতি খেয়াল করে , যদি কোন মুসলিম এই বিষয়ে শ্রমিককে স্বাধীনতা না দেয় কাল কিয়ামতের ময়দানে জবাব দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাত থেকে অধিক পছন্দ করে, আর আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং তাতে বক্রতার সন্ধান করে; তারা ঘোরতর ভ্রষ্টতায় রয়েছে। (সূরা ইব্রাহিম :৩) অন্য আয়াতে বলেন, তুমি কি দেখেছ, যদি সে হিদায়াতের উপর থাকে, অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়? যদি সে মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়? সে কি জানেনা যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ দেখেন? ( সূরা আলাক:১১-১৪) শ্রমিককে ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করতে দিলে এতে শ্রমিকের কাজে আগ্রহ বাড়ে, কেননা শ্রমিক দ্বীন অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের আপন কাজে আরো বেশি নিষ্ঠাবান ও যত্নবান বানাবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে শ্রমিকের অধিকার বুঝার তৌফিক দান করুক ।

লেখক : আহবায়ক, বাংলাদেশ কওমী ছাত্রপরিষদ