| |
               

মূল পাতা আন্তর্জাতিক সাদ্দাম হোসেনের আমলে দেশ ভালো ছিল : গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনালের জরিপ


সাদ্দাম হোসেনের আমলে দেশ ভালো ছিল : গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনালের জরিপ


আন্তর্জাতিক ডেস্ক     06 April, 2023     04:48 AM    


২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক আগ্রাসনের পর ইরাকের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে বলে মনে করেন দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিতে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতনের ২০ বছর পূর্তির সময় চালানো এই জরিপে বিভিন্ন বিষয়ে ইরাকি জনগণের মনোভাব সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইরাকের ১৮টি প্রদেশে জাতীয় প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা অনুযায়ী, ২ হাজার ২৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক ইরাকির সাথে মুখোমুখি দেখা করে এই জরিপ চালিয়েছে গ্যালাপ। মার্কিন হামলার আগের তুলনায় ইরাকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ বলেন, অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। অন্যদিকে ৪০ শতাংশ মনে করেন দেশটির পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া আরব জনগোষ্ঠী ২০০৩ সালের পর থেকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সুন্নি আরব, কুর্দি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। আর এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন জরিপেও ফুটে উঠেছে, যেখানে সুন্নি মুসলমান উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৪ শতাংশ বিশ্বাস করেন, সাদ্দাম হোসেনের অধীনে তাদের জীবন সুন্দর ছিল।

জরিপের এই নিরাশাজনক ফলাফল সত্ত্বেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে অগ্রগতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। উত্তরদাতাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ইরাকের অবস্থাকে ‘খারাপ’ বলে বর্ণনা করেন। গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল যখন তার আর্কাইভে গিয়ে ২০০৩ সালে একই প্রশ্নের উত্তরের সাথে এই জবাব মিলিয়ে দেখে, তখন দেখা যায়, প্রতি তিনজনের মধ্যে দু’জন ইরাকি সেই সময়ও এই কথাই বলেছিলেন।আনবার প্রদেশের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জরিপ দলকে বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি বা অবনতি হয়েছে কি না তা বলা কঠিন। যে কোনও পরিবর্তন মনে আশা জাগায় আর তখন আমরা অতীতকে ভুলে যাই। অর্থনীতির উন্নতি হয়তো কিছুটা হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন এবং নিরাপত্তা কমে গেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করেছিল এই বিশ্বাস থেকে যে দেশটির হাতে ‘গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র’ ডব্লিউএমডি রয়েছে এবং সাদ্দাম হোসেনের সরকার বিশ্ব নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। কিন্তু ডব্লিউএমডি কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর পরবর্তী যুদ্ধের ফলে কয়েক হাজার ইরাকি প্রাণ হারান এবং সে দেশে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এই হামলার জন্য মার্কিন সরকার যে অজুহাতই দিক না কেন, বহু ইরাকি যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনও সন্দিহান। প্রায় ৫১ শতাংশ ইরাকি বিশ্বাস করেন, ইরাকের সম্পদ লুঠ করার জন্যই যে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে ওই হামলা চালিয়েছিল। এই মনোভাব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশগুলোতে এবং আনবার প্রদেশে যেখানে প্রচুর তেল ও গ্যাস সম্পদ রয়েছে।

অন্যদিকে জরিপকৃতদের মধ্যে ২৯ শতাংশ মনে করেন, ওই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল সাদ্দাম হোসেনের সরকারকে উৎখাত করা। যুদ্ধের অন্যান্য কারণ, যেমন মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের স্বার্থ রক্ষা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো এবং ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এগুলো সম্পর্কে উত্তরদাতাদের আগ্রহ ছিল কম। মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানের অবসান ঘটার পর বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি হয়। প্রতিবেশী ইরানও ইরাকে হস্তক্ষেপের একটি সুযোগ খুঁজে পায়। বিশেষ করে যেহেতু ইরাকের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ শিয়া মুসলমান। সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে দীর্ঘদিন ধরে এদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল।ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর উত্থানের সময় তারা উত্তরাঞ্চলের অধিকার বঞ্চিত সুন্নি জনসংখ্যার কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছিল। আর ২০১৪ সালে ইরাকের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনাকে ঘিরে শুরু হয় এক নতুন লড়াই। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সামরিক সমর্থনের জেরে আইএসকে বাগদাদ থেকে বিতাড়ন করা হয়। এরপর থেকে সে দেশে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।

জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, তাদের দেশে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার প্রশ্নটি নিয়ে ইরাকিরা এখনও বিভক্ত। ২০০৭ সালে যুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন ইরাকে মোতায়েন মার্কিন সৈন্যদের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। আর এখন মোতায়েন রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সৈন্য। ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী উত্তরদাতারা অবিলম্বে মার্কিন প্রত্যাহারের পক্ষপাতী। কিন্তু কুর্দি অঞ্চলসহ ইরাকের উত্তর অংশের বাসিন্দারা মনে করেন সে দেশে কোন এক ধরনের মার্কিন উপস্থিতির এখনও প্রয়োজন রয়েছে। জরিপে ৭৫ শতাংশ শিয়া উত্তরদাতারা তাদের দেশে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর অভিযানকে খারাপ ঘটনা বলে মনে করেন। রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে মিত্রদেশ হিসেবে তারা রাশিয়াকে সমর্থন করেন। তেহরান এবং মস্কোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পটভূমিতে একটি অস্থিতিশীল দেশে এই মনোভাব হয়তো অবাক করার মতো বিষয় নয়। অর্থনৈতিকভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ভাবমূর্তি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়েছে, যদিও ঐতিহ্যগতভাবে এই অঞ্চলটি মার্কিন নিরাপত্তা বলয়ের অংশ। বেইজিং সরকার সম্প্রতি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে দাঁতাত বা বৈরিতার অবসান ঘটিয়েছে এবং ওই দুই দেশ আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে একমত হয়েছে। কিন্তু ইরাকে তরুণদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিশরিন কিংবা অক্টোবরের সামাজিক আন্দোলন যেটি ২০১৯ সালে বাগদাদের রাস্তা থেকে শুরু হয়েছিল এবং যে আন্দোলনগুলোকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল, তা থেকেই ব্যাপারটা ফুটে উঠেছে।

জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৪৭ শতাংশ ইরাকি দেশের ভেতরে থেকেই নতুন দেশ গড়ে তুলতে আগ্রহী। অন্যদিকে, ২৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি চারজনের মধ্যে একজন উত্তরদাতা দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জরিপে বলেছেন, ইরাকি যুব গোষ্ঠী, বিশেষ করে বাগদাদে বসবাসকারী পুরুষরা, মনে করছেন যে দেশের বাইরে তাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। এবং এই ফলাফলকে যদি আপনি বয়সের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেন তখন জানা যায় নতুন একটি ঘটনা। ১৮-২৪ বছর বয়সী ইরাকিদের প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজন দেশ ছাড়তে চান। ইরাকের বর্তমান রাজনৈতিক শ্রেণী এবং দুর্নীতির দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে এটি এক কঠোর রায়। কিন্তু ইরাকের জটিলতা শুধু পরিসংখ্যানের হিসেব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। গত দু’দশক ধরে লক্ষ লক্ষ ইরাকি ট্রমা আর গোলযোগের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যেও ইরাকে একটি নতুন প্রজন্মের উত্থান ঘটছে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সমস্যার বোঝা ঘাড়ে নিয়েই এরা একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। এখন ১৫ বছরের কম বয়সী ইরাকিরা সে দেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশ। এই তরুণ প্রজন্ম শান্তি ও স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং কাজের সুযোগের পক্ষপাতী। আশা করা যায়, ইরাকের নেতারা এবং তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থকরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবেন। বিবিসি বাংলা।