মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী 07 March, 2023 07:57 PM
শবে বারাআত অর্থ গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের রজনী। হাদীস শরীফে এ রাতকে “লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান” নামে ব্যক্ত করা হয়েছে অর্থাৎ শা‘বান মাসের মধ্য রজনী। শবে বারাআত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস এসেছে। তার মধ্যে একটি হাদীস ‘সহীহ’, কিছু হাদীস ‘হাসান’ আর কিছু ‘জয়ীফ’। এ জন্য শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস জয়ীফ-একথা বলা ঠিক নয়।
সনদের বিচারে সবচেয়ে উত্তম বর্ণনা সেটা যা ইবনে হিববান ‘কিতাবুস সহীহ’ তে (হাদীস ৫৬৬৫) বর্ণনা করেছেন। সেটা হচ্ছে- عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن. হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।’
আরো একাধিক হাদীসে এ বিষয়টি এসেছে। যেগুলোর সনদ ‘হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী।’ যথা মুসনাদে আহমদ এর ৬৬৪২ নং হাদীস, এবং মুসনাদুল বাযযার (২০৪৫)-এ আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত হাদীস। এছাড়া এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়--
হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন- هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم. ‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩৮২-৩৮৩
ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-- هذا مرسل جيد এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।
আল্লামা আবদুল হাই লাখনৌবী রাহ. ‘আল আছারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ’ (পৃ. ৮০-৮৫)তে লিখেছেন যে, “শবে বারাআতে রাত্রি জেগে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল যাতে আগ্রহ বোধ হয় তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ যত রাকাআত ইচ্ছা নামায পড়তে পারে। কিন্তু এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরনের কথা পাওয়া যায় সেগুলো ‘মওযু।’ বরং স্বাভাবিকভাবে যত ইচ্ছা সাধারণ নিয়মে নফল নামায পড়তে পারে। এ রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী এবং এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করা মুস্তাহাব-এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত। মোটকথা, এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা যেমন ভুল, তদ্রূপ মনগড়া কথাবার্তায় বিশ্বাসী হওয়াও ভুল।”
এ রাতে করণীয়--
এ মহামান্বিত রাতে করার মত নির্দিষ্ট কোন আমল নেই। সবাই কোথাও একত্র হয়ে সম্মিলিত কোন আমলও নেই। উল্লেখিত হাদীসের আলোকে এ রাতের আমল হল- ১-ইস্তিগফার তথা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। ২-আড়ম্বরপূর্ণভাবে নয় স্বাভাবিকভাবে হলে কবর যিয়ারত করা। ৩-অনির্ধারিতভাবে নফল ইবাদত করা। তবে এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী একাকিভাবে যার যার মতো করে নির্জনে করাই বাঞ্ছনীয়। ৪-পরদিন রোযা রাখা।
এ রাতে বর্জনীয়--
১. হালুয়া-রুটির মত আনন্দ উল্লাসের আয়োজন বর্জন করতে হবে। আল্লাহর কাছ থেকে মাফ পেতে হলে তার ইবাদত করতে হবে, খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে ফুর্তি করার মাধ্যমে নয়। হালুয়া-রুটির প্রথা বদরসম ও বিদ‘আত। ২. আতশবাজি করা,বোমা ফুটানো, রং ছিটানো প্রভৃতি মারাত্মক গুনাহর কাজ। ৩. সম্মিলিত কোন আমলকে এই রাতে আবশ্যকীয় মনে করা বিদ‘আত।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, মাসিক আদর্শ নারী