| |
               

মূল পাতা আরো সম্পাদকীয় সাধারণ সাথী ও উলামায়ে কেরামের দূরত্ব; কারণ ও করণীয়


সাধারণ সাথী ও উলামায়ে কেরামের দূরত্ব; কারণ ও করণীয়


মাওলানা ইমদাদুল হক নোমানী     12 January, 2023     05:37 PM    


আমারা নানা মরহুম ওয়াছিল চৌধুরী ছিলেন একজন আলেম ভক্ত এবং দাওয়াত ও তাবলীগের কট্টর যিম্মাদার সাথী। মাদ্রাসায় প্রাথমিক স্তরে পড়াকালীন একদিন নানাবাড়ি গেলে, নানাজি খেতে বসে জিজ্ঞেস করলেন- নামাজের দায়েমি ফরজ ও সুন্নত কয়টি? আমি তখন সঠিক উত্তর দিতে পারিনি। রেগে গিয়ে বললেন- "তোমরা মাদ্রাসায় কি পড়? তোমাদের উস্তাদরা কী পড়ায়? তাবলীগে যাও। সব শিখতে পারবে।"

সেদিন থেকে তাবলীগের সাথে আমার পরিচয় ও আকর্ষণ জন্মে। মনে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় আমাদের এলাকায় একটা জামাত আসলে, খেদমতের মাশওয়ারায় ঘর থেকে একপট চাউল এনে দুইদিন তাদের সাথে অনিয়মিত সময় লাগিয়েছিলাম। এরপর থেকে একাধিকবার ২৪ ঘন্টার ছাত্র জামাত, তিনদিনের জামাত, ঢাকা-গাজীপুর ও মৌলভীবাজারে চিল্লা এবং আহলিয়াসহ তিনবার মাস্তুরাতে নিয়মিত সময় লাগিয়েছি।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, নানাজির সেদিনের ধমকে বয়সে ছোট্ট হলেও আমার মাঝে একটা প্রশ্ন জেগেছিলো। দায়েমি বা কায়েমি নামে না হলেও এই মাসআলাগুলো ত মাদ্রাসায় পড়া-পড়ানো হয় এবং আমিও আদইয়ায়ে মাসনুনাহ ও তা'লীমুল ইসলামে পড়েছি। যদিও আমি বুঝের অভাবে তখন নানাজির পরিভাষায় পরিপূর্ণ উত্তর দিতে পারিনি। কিন্তু মাদ্রাসার প্রতি উনার এতো রাগ কেনো?

তাবলীগে বেশিরভাগ সাধারণ সাথী এবং সিলেট খোজারখলা মার্কাজের শুরা সদস্য সৈয়দ ইব্রাহিম সাহেব, জনাব আছাব উদ্দীন, মাস্টার শুয়েব আফজাল রহ., আহলে শুরা ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম খলীল রহ.সহ অনেকের সাথে আমি সময় লাগিয়েছি। কাকরাইল, খোজারখলা মার্কাজ এবং অখন্ড সিলেটের বিভাগীয় ইজতেমায় বিভিন্ন নজমেও দায়িত্ব পালন করেছি। গেলো বছর ইন্ডিয়া দিল্লির নিজামুদ্দিন মার্কাজ সফর করে বিভিন্ন বিষয়ে স্বচক্ষে দেখা ও জানার চেষ্টা করেছি। অর্জিত ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে আলেম ও সাধারণ সাথীদের মাঝে আজকের এ দূরত্ব সম্পর্কে কিছু অনুভূতি প্রকাশ করছিঃ

হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর চাহাত ছিল, দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের মাধ্যমে আওয়ামের মাঝে দ্বীনের তলব পয়দা করা। আওয়াম উলামায়ে কেরামের খেদমতে যাবে, সম্পর্ক রাখবে এবং মহব্বত করবে। যার ফলে তাদের জন্য দ্বীনি ইলম শেখা সহজ হবে এবং দ্বীনদার হতে পারবে। হযরতজী রহ. বলতেন, আওয়ামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন শেখানো এবং দ্বীনের পথে পরিচালিত করা এই জামাতের পক্ষে সম্ভব না। বরং উলামা হযরাত-দ্বীনদারদের মাধ্যমেই আওয়াম দ্বীন পাবে।

যেই মেহনত আওয়ামকে আলেমদের সাথে যুক্ত করার জন্য ছিল, সেই মেহনত সঠিক উসুলে পরিচালিত না হবার কারণে আজ অনেক লোক আলেমদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে এবং হয়েও গিয়েছে। কিছু রুসুমি কথা এবং ভুল চিন্তা উলামাদের থেকে আওয়ামকে বিচ্ছিন্ন করার অন্যতম কারণ। যেসব ভুল চিন্তা ও ধারণা সাথীদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১. ঈমানের মেহনত 
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদা হলো, নেক আমলের দ্বারা ঈমানের শক্তি ও নূর বৃদ্ধি পায়। আর গুনাহের দ্বারা বা আমল ছেড়ে দিলে ঈমানের শক্তি ও নূর কমে যায়। এটা অস্বীকারের সুযোগ নাই যে, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজও গুরুত্বপূর্ণ একটি নেক আমল। এর দ্বারাও ঈমানের শক্তি ও নূর বৃদ্ধি পায়। 

কিন্তু কিছু সাধারণ সাথীরা তাবলীগের কাজকেই একমাত্র ঈমানের মেহনত মনে করে। অন্যান্য নেক আমল যেমন- নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, তা'লীম, তাযকিয়া, যিকির ইত্যাদি যে ঈমানের মেহনত সেটা ভুলে যান। তারা মনে করেন, তাবলীগ ঈমানের মেহনত আর মাদ্রাসা ইলমের মেহনত এবং খানকা হলো জিকিরের মেহনত। উলামারা ঈমানের মেহনত (তাবলীগ) করে না বিধায় ঈমানের হাকিকত তাদের হাসিল হয় না। এ ভুল ধারণা থেকেই আওয়াম সাথীদের বিচ্ছিন্ন এক জনগোষ্ঠি তৈরী হয়ে গেছে, যারা উলামাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে দূরত্ব বজায় রাখে।

২. কালেমার হাকীকত
অনেকে আওয়াম বা সাধারণ সাথী মনে করে- গাট্টি নিয়ে তাবলীগে বের না হলে, হিজরত না করলে, বাড়ি-ঘর ত্যাগ না করলে দীলের ইয়াক্বীন সহিহ হবে না এবং কালেমার হাকীকত অর্জিত হবে না। যারা চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করে এক চিল্লা, তিন চিল্লার জন্য সফরে বের হয় না, তাদের ঈমানের হাকীকত অর্জন হয় না।

মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ইমাম, উলামা-মাশায়েখ সবাই এই কাতারে শামিল। মসজিদ, মাদ্রাসা এবং খানকায় যে ঈমানের মেহনত হয়, তারা সেটা না বুঝার কারণে ভুল ধারণা থেকেই উলামাদের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন এবং দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

৩. দ্বীনের কাজে ভাতা গ্রহণ
অনেক সাধারণ সাথী ভাইরা মাদ্রাসা শিক্ষক ও ইমাম সাহেবদের বেতন-ভাতা গ্রহণকে ভাল চোখে দেখেন না। এটাকে দ্বীনি খেদমত মনে না করে নিছক অর্থোপার্জনের মাধ্যম ভাবেন। তারা মনে করেন, দ্বীনের কাজ করলে গায়েব থেকে সব ব্যবস্থা হবে। অথচ গায়েব থেকে সরাসরি কোন কিছুর ব্যবস্থা হওয়া কারামত। আর কারামত এখতিয়ারী বিষয় না, এর জন্য মানুষ আদিষ্ট না এবং এটা অর্জনে কোন সওয়াবও নাই। বরং কারামত'র জন্য চেষ্টা করা বা এর আকাঙ্খা করা নিতান্তই গোমরাহি।

বাস্তবতা হলো, কামাই-রোজগারের জাহেরি ব্যবস্থা রাখা সুন্নত। খেলাফতে রাশেদা ও সাহাবাদের আমল দ্বারা তা প্রমাণিত। উলামারা এ সুন্নতের অনুসরণ করছেন। কিন্তু আওয়ামদের না জানা-বুঝা অথবা তাদেরকে ভুল মেসেজ দেওয়ার কারণেই তারা এবং উলামায়ে কেরামের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

৪. নবীওয়ালা কাজ
দাওয়াতের মেহনত নবীওয়ালা কাজ। এ কথা বলতে-বলতে এবং প্রচার করতে-করতে সাধারণ সাথীদের মনে এমন বদ্ধমূল ধারনা তৈরী হয়েছে যে, মাদ্রাসা-মসজিদ-খানকা এবং জেহাদ ও খেলাফত নবীওয়ালা কাজ না।

রাসূল সা.কে 'মা উনযিলা'র (কুরআন ও হাদীস) তাবলীগ করতে বলা হয়েছে। আর 'মা উনযিলা'র তাবলীগ না করলে রিসালাতের দায়িত্ব আদায় হবে না। সুতরাং নবীওয়ালা তাবলীগ করতে হলে 'মা উনযিলা' বা কুরআন-হাদীসের ইলম লাগবেই। নবীওয়ালা তাবলীগ শুধুমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব, যাদের কাছে কুরআন-হাদীসের ইলম আছে অর্থাৎ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া বা হক্কানী উলামায়ে কেরাম। এ বিষয়টি সাধারণ সাথীদের না বুঝাও উলামায়ে কেরামের সাথে দুরত্বের একটি কারণ।

৫. জিন্দেগীর মাকসাদ
আওয়াম সাথীরা বলেন, এই কাজকে জিন্দেগীর মাকসাদ বানিয়ে করা। কেননা নবীগণ এবং সাহাবারা দাওয়াতকে জীবনের মাকসাদ বানিয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে জিন্দেগীর মাকসাদ হলো- পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। এই কাজ বা মেহনত হলো, জুয বা অংশ। আর দ্বীন হচ্ছে কুল বা সমগ্র। জুয কখনো মাকসাদ হতে পারে না।

সাথীরা অনেকে ভাবেন; আমাদের মাকসাদ দাওয়াত। আলেমদের মাকসাদ ইলম। পীরদের মাকসাদ খানকা। এভাবে ভুল ধারণার কারণে আওয়ামদের একটা জনগোষ্ঠি তৈরী হয়ে গেছে যারা না বুঝার কারণে উলামাদেরকে অপছন্দ করে। আওয়াম ও উলামাদের মাঝে দূরত্বের এটাও একটি অন্যতম কারণ।

আরও অনেক কারণ আছে, যা এ পরিসরে বলা সমীচীন মনে করছি না। এক প্লেটে খাওয়া, এক কাতারে ঘুমানো, এক লাইনে চলে গাশত করা মহব্বতের প্রিয় দ্বীনি ভাইদের এ অবস্থা নিশ্চয়ই দুঃখজনক। আমার বিশ্বাস, কেউ বুঝে আবার কেউ হয়তো না বুঝে উভয়ই একান্তে চোখের পানি ফেলে আফসোস, আক্ষেপ করছেন। হাউমাউ করে কেদে বুক ভাসান। আবার কেউ কেউ চোখ বা লোকলজ্জায় হীনমন্যতায় ভুগছেন। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।

আওয়াম বা সাধারণ সাথী ভাইদের জন্য করণীয় হলো- জরুরীয়াতে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণ করা, উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে চলা এবং মুরব্বি ও অভিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা। বুঝার চেষ্টা করা।

আহলে ইলমগণ উম্মতের অভিভাবক। মুহতারাম উলামায়ে কেরাম যাবতীয় দ্বীনি কাজের তত্ত্বাবধায়ক। গুরুত্বপূর্ণ সকল দ্বীনি ব্যস্ততার পাশাপাশি সময়-সুযোগে আওয়ামদেরকে দ্বীন শিখানোর বিষয়ে যথাসাধ্য আরও মনোযোগী হওয়া। সাধারণ সাথীদের বদ্ধমূল ধারণা এবং ভুল চিন্তা-ভাবনা মহব্বতের সাথে ধরিয়ে দেওয়া। দূরে ঠেলে না দিয়ে সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে কাছে টানা। পরস্পর ঝগড়া, ফাসাদ না করে আলোচনার মাধ্যমে এক ও নেক হবার মেহনত অব্যাহত রাখা।

মনে রাখবেন, আওয়াম উলামাদের সোহবত থেকে ছুটে গেলে নাস্তিক, মুরতাদ, সেকুলার বা ইহুদী, নাসারাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে যাবে! এই বিশাল জনগোষ্ঠি আহলে ইলমের দিকনির্দেশনা থেকে দূরে সরে গেলে এদের দ্বারাই নতুন নতুন ফিতনার সয়লাব চালু হবে। শকুনের হাত থেকে রক্ষা করতে সঠিক সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত না নিলে একসময় পস্তাতে হবে। সেই সুযোগে দিশেহারা উম্মত হয়ে যাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ। আল্লাহ সবাইকে বুঝার তাওফিক দান করুন। আপসে জোড়, মিল, মহব্বত তৈরি করে দিন। আমীন।


লেখক, সাধারণ সম্পাদক, আঞ্জুমানে তালীমুল কুরআন বাংলাদেশ।