মুফতী জাবের কাসেমী 16 December, 2022 06:31 AM
৫১ পেড়িয়ে ৫২ তে পা রাখলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। একটি জাতির জন্য এই বয়স তেমন কিছু নয়; তবে দেশ হিসাবে ৫১ বছর সময় একেবারে কম নয়। চীন, ভিয়েতনাম ৫১ বছরে অনেকদূর এগিয়েছে; বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে প্রাপ্তির হিসেবে গড়মিল থাকলেও অর্জন কম হয়নি। আমাদের প্রাপ্তির তালিকা যেমন বেশ বড়, সমৃদ্ধ, গৌরবময়, তেমনি হতাশারও অনেক কিছু জমেছে। এ সময়ে আর্থ সামাজিক উন্নতি এবং মানুষের যাপিত জীবনে যেমন ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, তেমনি স্বপ্ন পুরণে ব্যর্থতার হতাশাও ভারি হয়েছে অনেক।
ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম৷ স্বভাবধর্ম৷ আর মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি চায় যে, সে স্বাধীন থাকবে৷ সে নিরঙ্কুশ কোন সত্ত্বার নিকট ছাড়া অন্য কারো নিকট নতিস্বীকার করতে চায় না৷ তাই মানুষ যখনই সে আগ্রাসী কোন শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়, যখন তার স্বাধীনতাকে কোন না কোনভাবে খর্ব করা হয়, তখন সে প্রতিবাদী হয়ে উঠে৷ পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে বহু জাতি পরাধীনতার গ্লানি বরদাশত করে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে৷ কোন কলাকৌশল, কোন বিদ্যা- বুদ্ধি, কোন ছলচাতুরী তাদেরকে মুক্ত করতে পারেনি, যতক্ষণ না আল্লাহর অনুগ্রহ ও আনুকুল্য লাভ করেছে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “আমি বনী ইসরাঈলকে অপমানজনক শাস্তি থকে উদ্ধার করেছি”৷ (সূরা দুখান- ৩০ আয়াত)।
এ আয়াতে অপমানজনক শাস্তি দ্বারা পরাধীনতা ও দাসত্বের জীবনকে বুঝানো হয়েছে৷ সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা আল্লাহ প্রদত্ব এক বড় নিয়ামত৷ পরাধীনতা আল্লাহর লা’নত৷ স্বাধীনতা অর্জনে বিমুখতা ও কাপুরষতা আল্লাহর গজবের মধ্যে গন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ স্বাধীনতার নিআমত হাছিল করতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়৷ জানমালের কুরবানী দিতে হয়৷ আত্মত্যাগ, আত্নবিসর্জন ছাড়া কোন জাতি পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেনি৷ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি৷
স্বাধীনতা যে কত বড় নিআমত তা বর্তমান প্রজন্ম যারা ১৯৭১ সালের পরবর্তি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেছে তারা এর স্বরূপ উপলদ্ধি করতে পারবে না৷ স্বাধীনতার সঠিক উপলদ্ধি তাদের আছে, যারা পরাধীনতা ভোগ করেছে৷ যারা জুলুমের স্বীকার হয়েছে৷ যারা লান্ঙ্ছনার শিকার হয়েছে৷ স্বাধীনতা যে কত বড় নিআমত তা বুঝা যায় কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান আর বর্তমানে মিয়ানমারের দিকে তাকালে৷
এ সব অঞ্চলের মানুষ আজ স্ব – স্ব দেশে পরাধীন৷ এক মুহূর্তের জন্য তাদের স্বস্তি নেই৷ জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই৷ ইজ্জত আবরুর কোন গ্যারান্টি নেই৷ কখন যে ঘাতকের বুলেট কার জীবন কেড়ে নেয়, হিংস্র হায়েনাদের লোলুপ দৃষ্টি কখন কার উপর পড়ে, কার সম্ভ্রব লুটে নেয় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই৷ স্ত্রী, ছেলে- মেয়ে, পরিবার – পরিজন৷ নিয়ে একটু আরামে ঘুমাবার, একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবার কোন সুযোগ নেই৷ অনেক মুসলিম এলাকার জনগণ ইহুদী, খৃষ্টান- বৌদ্ধ ও পৌত্তলিকদের দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে৷ এধারা আর কতকাল অব্যাহত থাকবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ভাল জানেন৷
এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য তা হলো ইসলাম স্বাধীনতার ধর্ম৷ ইসলাম আমাদেরকে এ শিক্ষা দেয় যে, একমাত্র নিঃশর্ত আত্নসমর্পর্ণ হবে আল্লাহ তায়ালার সমীপে৷ কোন জালিমের সামনে মাথা নত করার শিক্ষা ইসলাম দেয় না৷ ঠিক তেমনি ইসলামের সহী অনুসারী হক্কানী উলামায়ে কেরাম সর্বদাই স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি৷ বিপক্ষ শক্তি নয়৷ কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের বিষয়! এক শ্রেণির লোকেরা ঢালাওভাবে উলামায়ে কেরামকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হিসাবে সমাজে দাঁড় করাতে চায়৷ অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে উলামায়ে কেরামের অবদান জানতে আমাদেরকে বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই৷
নিকট অতীতেই এর উজ্জল দৃষ্টান্ত রয়েছে৷ ভারত উপমহাদেশে বৃটিশদের প্রায় দুশো বছরের অপশাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম উলামায়ে কেরামই ফতোয়া জারী করেছিলেন৷ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছলে বলে কৌশলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাত থেক বাংলা, বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা হরণ করে এবং উপমহাদেশের ক্ষমতা দখল করে আমাদেরকে প্রায় ১৯০ বছর গোলাম বানিয়ে রাখে৷ এরা ছিল মূলত ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি৷ এই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে বের করার জন্য হযরত শাহ আব্দুল আজীজ দেহলভী (রাহ.) বিপ্লবী ফতোয়া প্রদান করেছিলেন ১৮০৩ সালে৷
তারই প্রেক্ষিতে সকল উলামায়ে কেরাম ইংরেজের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ পরবর্তীতে শাহ সাহেবের অন্যতম খলিফা হযরত সাঈদ আহমাদ বেরলভী (রাহ.) ১৮২৬-১৮৩১ পর্যন্ত বালাকোট প্রান্তরে ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন এবং সেখানে শাহাদাতের অমিয় সূধা পান করেন৷ তাঁর সাথিরা ও তার সাথে শাহাদাত বরণ করেন৷ এটা হলো বৃটিশ বিরোধী ও আযাদী আন্দোলন তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ধাপ৷ এরপরে ১৮৫৭ সালে শামেলির ময়দানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহঃএর নেতৃত্বে সশস্ত্র জিহাদ হয়৷ সেখানে হাফেয যামিন (রাহ.) শাহাদাত বরণ করেন৷
হযরত গাঙ্গোহী (রাহ.) প্রধান বিচারপতি ছিলেন৷ হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী (রাহ.) সামরিক বিভাগের চিফ অফ স্টাফ ছিলেন৷ ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৮৫৭ সালের সেই জিহাদকে ও ব্যর্থ করে দেয়৷ যে কারণে দেশের হাজার হাজার উলামায়ে কেরামকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ অনেককে আন্দামান দ্বীপে দেশান্তর করা হয়৷ সেই ইতিহাস বড় করুণ৷ এহেন পরিস্হিতে উলামায়ে কেরাম শেষ রাতে উঠে কান্নাকাটি করতেন৷ সে কান্নাকাটির ফলে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলূম দেওবন্দ৷ যা মূলতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এলহামের মাধ্যমে৷ যার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল, সমাজের সর্বস্তরে কুরআন সুন্নার শিক্ষা চালু করা৷ সমাজ থেকে সবধরনের অন্যায়, যুলুম ও অশ্লিলতার মূলোৎপাটন করা৷ সুতরাং সেই দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষা দীক্ষাই জাতিকে সত্যিকার অর্থে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন করে ছিলো ১৯৪৭ সালে ১৯০ বছরের গোলামী থেকে৷
পাকিস্তান স্বাধীন হলো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট৷ আর হিন্দুস্তান স্বাধীন হলো ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট৷ পাকিস্তান গঠিত হয় ৫টি প্রদেশ নিয়ে৷ আর হিন্দুস্তান গঠিত হয় ২৫টি প্রদেশ নিয়ে৷ হিন্দুস্তানের প্রদেশগুলো ভৌগলিক দিক থেকে একটার সঙ্গে আরকেটা সংযুক্ত ও মিলিত ছিল৷ কিন্তু পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে চারটি ভৌগলিকভাবে সংলগ্নতা থাকলে ও পন্ঞ্চম প্রদেশ যেখানে আমরা বর্তমানে বসবাস করছি, পাকিস্তানের মূল ভূখন্ড থেকে এর দূরত্ব হলো দেড় হাজার মাইল
১৯৪৭ সালে পার্টিশনের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে স্থল পথে কোন সংসোগ না থাকা সত্বে ও শুধু মনের টানে মুসলিম পরিচয়ে জাতিভাই হিসেবে আমরা একীভূত হয়েছিলাম৷ পাকিস্তানী নেতারা জনগণের সঙ্গে ওয়াদা করেছিল, স্বাধীন পাকিস্তানে আইন রচনা করা হবে কুরআন – সুন্নাহভিত্তিক৷ পূর্ব ও পশ্চিমের জনগণের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকবে না৷ আইনের দৃষ্টিতে সকলে থাকবে সমান৷ জাতিগত কোন বৈষম্য থাকবে না৷ চাকরী- বাকরী, ব্যবসা- বাণিজ্যে, সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে৷ সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে৷ কিন্তু আফসোস! পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের কোন ওয়াদাই ঠিক রাখতে পারল না৷ তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই শুরু করলো একের পর এক গাদ্দারী, প্রতারণা আর বৈষম্য৷
পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর এতসব ঔপনিবেশিক মনোভাব, শোষণ, বৈষম্য জুলুম ও অত্যাচারের কারণেই সেদিন স্বাধীনতা- প্রিয় বাঙ্গালী জাতি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল৷ দীর্ঘ নয়মাস মরণপণ লড়াই করে অনেক রক্তের বিনিময় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমরা আবার দ্বিতীয় বার স্বাধীনতা লাভ করি ২৪ বছরের মাথায়৷ এর পূর্বে ১৯০ বছরের গোলামি ছিল৷ সেখান থেকে জাতিকে মুক্ত করার অবদান হলো উলামায়ে কেরামের৷ এখানে একটা বিষয পরিস্কার যে, এই ২৪ বছর এতে ও উলামায়ে কেরাম বসে ছিলেন না; বরং তারা কুরআন- সুন্নাহ ভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন৷ হযরত মাওলানা আতহার আলী সাহেব (রাহ.), হযরত মাওঃভাসানী (রাহ.), হযরত মাওঃ সোহরওয়ার্দি (রাহ.) সহ সকল উলামায়ে কেরাম যুক্ত ফ্রন্ট গঠন করেছেন মুসলিমলীগের বিরুদ্ধে৷ এ যুক্ত ফ্রন্টই ছিলো মৈালিকভাবে মুসলিমলীগের বিরুদ্ধে৷ শোষণের বিরুদ্ধে৷ জুলুমের বিরুদ্ধে৷
কিন্তু যুক্ত ফ্রন্টকে কাজ করতে দেয়া হয় নি৷ সে সময় দেশে মার্শাল ল চালু করা হয়৷ যার সূচনা করে ইস্কান্দার মির্জা পরে আইয়ুব খান৷ তারপরে ইয়াহইয়া খান৷ এর পরে তো পূর্ব পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিছু অদূরদর্শী ও বিভ্রান্ত ব্যক্তি ধর্মের নামে শুধু পাকবাহিনীকে সমর্থন করে ক্ষান্ত হয়নি; বরং তাদের জুলুম ও নির্যাতনে মদদ যুগিয়েছে৷ নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে৷ এর বিপরীত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে এদেশের আলেম উলামা বিশেষ করে দারুল উলূম দেওবন্দের বাংলাদেশী কৃতি সন্তানদের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে৷
যেমন- আল্লামা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযূর (রাহ.), ঢাকার আরজাবাদ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা জমিয়ত নেতা আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী (রাহ.), আল্লামা কাজী মুতাসীম বিল্লাহ (রাহ.), আল্লামা মোস্তফা আজাদ (রাহ.) ও শায়খে বাঘা আল্লামা বশির আহমাদ (রাহ.) উল্লেখযোগ্য৷ সুতরাং এদেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে আলেমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন৷
মোটকথা, আমরা দুইবার স্বাধীনতা অর্জন করেছি৷ প্রতিবারই দেশের উলামায়ে কেরাম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন৷ কিন্তু এদেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে হলে এবং স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে হলে কুরআন – সুন্নাহর আইন চালু করতে হবে৷ কেননা, কুরআনের আলো ছাড়া আমরা কখনো স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারবো না৷ আমরা দুই দুই বার স্বাধীনতা অর্জন করেছি ঠিক কিন্তু দেখা যায় এখনো আমাদের জীবনের নিরপত্তা নেই, মালের নিরাপত্তা নেই৷ আজ আমাদের সমাজের সর্বস্তরে দূর্নীতি৷ আমাদের সমাজের করুন অবস্হা৷ এ অবস্থা থেকে আমাদেরকে অবশ্যই উত্তীর্ণ হতে হবে৷ সুতরাং স্বাধীনতা দিবসে নতুন করে দেশ গড়ার , জনগণের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার শপথ নিতে হবে৷
আল্লাহ পাক আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমের হেফাজত করুন৷ দেশ ও জাতির কল্যাণে আমাদের সকলকে কাজ করার তাওফীক দান করুন৷ আমীন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, খতীব সরদারবাড়ী জামে মসজিদ মানিকনগর ঢাকা।