রহমত ডেস্ক 02 April, 2022 06:49 PM
‘বলতে চাই’ এবং ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ নামে দু’টি অ্যাপস উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এগুলো অটিস্টিক ব্যক্তি, কথা বলতে সমস্যায় থাকা ব্যাক্তিদের কথা বলতে এবং অটিজম চিকিৎসায় সহায়ক হবে। নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্ট’র অধীনে ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তি এবং অটিজম আক্রান্তদের স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। আমরা ট্রাস্টের মাধ্যমে তাদের জন্য হোস্টেল বা ডরমিটরি তৈরি করতে পারি যেখানে তাদের দেখাশোনার জন্য লোক থাকবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্নসহ ভিন্নভাবে সক্ষম লোকদের জীবন সুরক্ষিত করার জন্য তাঁর সরকার তাদের জন্য স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। আমাদের ৮টি বিভাগ আছে। আমরা এই ৮টি বিভাগে প্রথমে এটি (স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থান) প্রতিষ্ঠা করবো এবং পর্যায়ক্রমে আমরা প্রতিটি জেলায় তৈরি করবো।
আজ (২ এপ্রিল) শনিবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে-বিআইসিসিতে ১৫ তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এবারে ওয়ার্ল্ড অটিজম অ্যাওয়ারনেস ডে-২০২২ এর প্রতিপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মক্ষেত্র’। অটিজমে আক্রান্ত শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের জীবন উন্নত করতে সকলের দ্বারা ব্যাপক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২ এপ্রিলকে ওয়ার্ল্ড অটিজম অ্যাওয়ারনেস ডে ঘোষণা করে। সমাজ কল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু এবং সচিব মাহফুজা আক্তার বক্তব্য রাখেন। অন্ষ্ঠুানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সমাজ কল্যাণমন্ত্রী বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্যে চারটি ক্যাটাগরিতে অটিজমে আক্রান্ত তিন শিশু, তিনটি সংস্থা, দু’জন ব্যক্তি এবং একজন মায়ের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। সমাজে অবদান রাখার জন্যে অটিজমে আক্রান্ত তিন শিশু মাসুদুল ইমান, মুনতাসির ইনাম এবং ইসাবা হাবিব সুশমির প্রত্যেকের হাতে একটি ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট এবং ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে দেয়া হয়। এছাড়া, অটিজমে আক্রান্তদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবদান রাখায় তিন সংস্থা এনআই খান ফাউন্ডেশান, আরটিভি এবং ফাউন্ডেশান ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন এবং দু’জন ব্যক্তি সুবর্ণ চাকমা, প্রফেসর খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুনকে সম্মানজনক মানপত্র প্রদান করা হয়। এছাড়া, অটিস্টিক শিশুর সফল মা শারমিন চৌধুরীকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পক্ষে অনুষ্ঠানে ছোট্ট শিশু ইসাবা হাবিব সুশমি বক্তব্য রাখে। এছাড়া, অনুষ্ঠানে অটিজমে আক্রান্তদের সুন্দর ও উন্নত জীবনের লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ওপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়।
সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্থায়ী বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে বলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাদের অভিভাবকরা সমর্থন দিতে অক্ষম এমন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিরাপদ জীবন যাপনের জন্য এই প্রকল্প স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। সরকার অটিস্টিক ও ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য সমাজে সুন্দর ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে কাজ করছে। আমরা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য একটি সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। যাতে তাদের জীবন অর্থবহ হয় এবং সুপ্ত মেধা বিকশিত হতে পারে। দেশের সকল ধনী নাগরিকদের দায়িত্ব ভিন্নভাবে সক্ষম লোকদের যত্ন নেয়া। তারা আমাদের অত্মার আত্মীয়। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, কারণ তাদের অনেক প্রতিভা রয়েছে। সকলকে বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিদের ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর এবং তাদের আর্থিক সহায়তা এবং চাকুরিসহ প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা প্রদানের আহবান জানান তিনি। তাদের প্রতি আর অবহেলা না করার আহবান, আমাদেরকে তাদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে।
বিশেষ অলিম্পিকে স্বর্ণ এবং রৌপ্য বিজয়ী এবং সম্প্রতি চার দেশের বিশেষ ক্রিকেট টুর্ণামেন্টে চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা অর্জনে বাংলাদেশী ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের সাফল্যের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের সাধারণ খেলোয়াড়রাও এটা পারেন না। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার ভিন্নভাবে সক্ষম জনগনের উন্নতিতে কাজ করতে শুরু করে। ওই সময়ে অটিজম শব্দটি পরিচিত ছিল না। বাংলাদেশে বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত, এমনকি তার কাছেও। অটিজম বিষয়ে গুরুত্ব এবং সচেতনতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বেড়েছে। পিতামাতা ও অভিভাবকদের প্রতি তাদের সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা বিষয়ে লজ্জাবোধ এড়িয়ে সমাজের মূলধারায় অটিস্টিকদের সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টার জন্যে অনুরোধ জানান। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে এ ধরনের সন্তানের সাথে আরো বেশি সময় ব্যয় করারও আহ্বান জানান।
সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বরোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদেরকে আমাদের সমাজের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। তাদেরও অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। আমরা যারা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যের অধিকারী আমাদের উচিত তাদের অধিকারের পূর্ণতা দেয়া। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বলেন, তাদেরকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষা লাভের সুযোগ দেয়া উচিৎ। তাদের জন্য শুধু সহশিক্ষার ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়। বরং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের আরো বেশি করে মেলামেশার সুযোগ দেয়া উচিৎ। অটিজম শিশুরা সাধারণ শিশুদের সাথে যত বেশি মেলামেশা করার সুযোগ পাবে, ততই তাদের সুস্থ হওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে। সরকার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের লেখাপড়ার চালিয়ে যাওয়ার জন্য মাসে ৭৫০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা ভাতা দিচ্ছে। এখন দেশের ২০ লাখ ৮ হাজার ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ মাসে ৭৫০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় ১ কোটি ২ লাখ লোক বর্তমানে বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল ডিজেবল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে। অটিজমদের সাথে কি আচরণ করতে হবে তা জানতে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েন, এ লক্ষ্যে, অভিভাবক, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণ জরুরি।বাংলাদেশ বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের ব্যাপারে খুবই সচেতন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সমাজকল্যাণ দপ্তরের তত্ত্বাবধায়নে সহশিক্ষা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য যথাযথ চিকিৎসা দিতে নবজাত শিশুদের অটিজম পরীক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ লক্ষ্যে, তাঁর সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পিডায়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (আইপিএনএ) স্থাপন করেছে। ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষের সুরক্ষার লক্ষ্যে পার্লামেন্টে দ্য পার্সনস ইউথ ডিজঅ্যাবিলিটি রাইটস অ্যান্ড প্রোটেকশন ট্রাস্ট অ্যাক্ট, ২০১৩ ও দ্য নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ২০১৩ আইন দুটি পাশ হয়েছে। ট্রাস্ট ল’ এর অধীনে ২০১৪ সালে একটি নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকার এতে ১৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁর সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ইতোমধ্যেই মীরপুরে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের জন্য একটি কমপ্লেক্স নির্মাণ করে দিয়েছে। ২০১০ সালে মীরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পাসে একটি ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার’ এর কার্যক্রম শুরু হয়। অটিস্টিক শিশু ও ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের বিনামূল্যে আবাসিক চিকিৎসা সেবা, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে একটি বহুমুখী কম্পেক্স সুবর্ণা ভবন স্থাপন করা হয়েছে। ২৭৫ ভিন্নভাবে সক্ষম ও অটিজম মানুষদের জন্য কম্পেক্সে আশ্রয় শিবির নির্মাণ করা হয়েছে। জাতির পিতা স্বাধীনতার পর এতিমখানা অথবা অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধায়নে ১৯টি জেলায় বিরাট এলাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারি চাকরিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য এক শতাশং কোটাও রেখেছিলেন। পরে, প্রধানমন্ত্রী অটিস্টিক শিশুদের পরিবেশিত একটি মনোজ্ঞ সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।