| |
               

মূল পাতা জাতীয় ইসলাম কি নারীবাদ বিরোধী?


ইসলাম কি নারীবাদ বিরোধী?


রহমত ডেস্ক     09 March, 2022     07:32 PM    


ইসলাম এবং নারীবাদ---এই শব্দবন্ধ দেখে অনেকেরই মনে প্রথম যে প্রতিক্রিয়া হবে তা হচ্ছে এ দুটি পরস্পর বিরোধী একটি ব্যাপার। অনেক মুসলিম নারীবাদকে সমর্থন করেন না। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিতর্ক আর বিতণ্ডারও শেষ নেই। নারীবাদীদের বক্তব্য, ইসলাম ধর্ম নারীর সমতাকে স্বীকৃতি দেয় না। ইসলাম ধর্মে নারীদের জন্য পর্দা প্রথার কথা বলা হয়েছে, যেখানে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া চলাফেরা না করার বিধান আছে, এর ফলে নারীর সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইসলামে নারীকে পুরুষের অধস্তন করা হয়নি। সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা হয়নি। কিন্তু ইসলাম এবং নারীবাদ কি আসলেই পরষ্পরবিরোধী কিংবা এই দুই আদর্শিক অবস্থানের সহাবস্থান কি সম্ভব?

নারীবাদ মানে কী : এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, নারীবাদ হচ্ছে এমন এক মতবাদ যা লিঙ্গ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমতার কথা বলে। মূলত পশ্চিমা দেশে এই মতবাদের শুরু হলেও, বিশ্বব্যাপী এ ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে, এবং নারীর অধিকার ও নারীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা ও আন্দোলনের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নারীবাদের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীবাদের উৎপত্তির ক্ষেত্রে কয়েকশ' বছর আগে ইউরোপের সামাজিক প্রেক্ষাপট মূল ভূমিকা রেখেছিল। সেসময় নারীর জন্য গৃহ এবং গৃহস্থালি ব্যাপারগুলো নির্দিষ্ট করে রাখা ছিল, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিল না এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ছিল না। বিশ্লেষকেরা বলেন, নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা অর্জনের লক্ষ্যে লিঙ্গীয় আধিপত্য অর্থাৎ নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব এবং আধিপত্যকে দেশে দেশে চ্যালেঞ্জ করে নারীবাদ।

ইসলামের সাথে নারীবাদ কি সাংঘর্ষিক? সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা আছে যে, নারীবাদের সঙ্গে যেকোন ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, ইসলাম ধর্মে সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকারে তাকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয়নি, এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও ইসলাম নারীর নেতৃত্ব স্বীকার করে না। কিন্তু ইসলামের সাথে নারীবাদের সরাসরি কোন বিরোধ বা দ্বান্দ্বিক অবস্থান আছে, একথা মানতে রাজী নন অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মোঃ সিদ্দিকুর রহমান খান বলেছেন, ‘ইসলাম ধর্মের সাথে নারীবাদের কোন দ্বন্দ্ব নেই। ইসলাম ধর্মে নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের গণ্ডি গৃহাভ্যন্তরে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি, বরং তার সামাজিক অংশগ্রহণ অনুমোদন করেছে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সেই সময়ের আরব সমাজে নারী অংশ নিত, সেটি নিষেধ করা হয়নি।

ইসলামের নবী মুহাম্মদের স্ত্রী এবং প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি বিবি খাদিজা নিজে ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি মক্কার ব্যবসায়ী সমিতির প্রধান ছিলেন। এর বাইরে ইসলামের নবী মুহাম্মদের সময় বিভিন্ন যুদ্ধে যোদ্ধা হিসেবে নারীরা যোগ দিয়েছিলেন, ফলে কোনভাবেই নারীকে সামাজিক অংশগ্রহণে বাধা দেয়া হয়নি। যদিও ইসলামের রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণের উদাহরণ দেখা যায় না। ইসলামের নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর খেলাফায়ে রাশেদীনের সময় চারজন খলিফাই ছিলেন পুরুষ। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সময় পুরুষকেই দেখা গেছে নেতৃত্ব দিতে।

তবে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাতেমা আনোয়ার বলছেন, উদাহরণ না থাকলেও নারীর নেতৃত্বের বিষয়ে ইসলাম ধর্মে সরাসরি নিষেধ নাই। আইনের ক্ষেত্রে সাধারণত একটা কথা বলা হয়, সেটা হচ্ছে পজিটিভ প্রহিবিশন---মানে যখন কোন কিছু নিষেধ বা না করা হয়নি তখন সেটিকে আমরা ধরে নিতে পারি যে তার অনুমতি আছে। কুরআনে এ বিষয়ে সরাসরি কিছু উল্লেখ নেই সত্যি, কিন্তু নারীর নেতৃত্বকে নিরুৎসাহিতও করা হয়নি।

অধ্যাপক মোঃ সিদ্দিকুর রহমান খান বলেছেন, তৎকালীন আরবের পশ্চাৎপদ সমাজে নারীকে নেতৃত্বে ভাবা মুশকিল ছিল, তারই ছাপ দেখা সমাজব্যবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক। আরবের সমাজ ব্যবস্থা তখন নারীর প্রতি খুবই অবমাননাকর ছিল, কন্যা-শিশুকে পরিবারের দায় মনে করে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলত অনেক পরিবার। সেখানে নারীকে অধস্তন না করে সম্মান দেয়া এবং সম্পত্তিকে তাকে অংশীদার করা ছিল অনেকটাই বৈপ্লবিক একটা ব্যাপার। তবে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে সরাসরি কুরআনে কোন নিষেধ নাই। ‘আর সে কারণেই দেশে দেশে নারী যখন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছে সেটি মেনে নেয়া হয়েছে।‘

সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমতা নেই : ইসলামি বিধান অনুযায়ী একজন নারী পিতার সম্পত্তিতে তার ভাই যে পরিমাণ সম্পত্তি পাবে তার অর্ধেক পাবে। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সম্পদের আট অংশের একভাগ পাবেন তিনি। যদি নারীর পুত্র থাকে এবং সে নিঃসন্তান হয় তাহলে তার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির ছয় ভাগের একভাগ পাবেন মা। অর্থাৎ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, নারী উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের সমান সম্পত্তির মালিক হননা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাতেমা আনোয়ার এর পেছনে ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলছিলেন, এখানে বিষয়টি দেখা হয়েছে এভাবে যে নারী সম্পত্তি কম পাচ্ছে, এবং সেজন্য তার দায়িত্বও কম। অর্থাৎ পিতার কিংবা স্বামীর মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির দেনা নারীর ওপর বর্তায় না। এছাড়া সম্পত্তির মালিক হতেও ইসলামে নারীর বাধা নেই। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, কুরআনে সুরা আন-নামল এ উল্লেখ আছে কুইন অব শেবা বিলকিসকে যখন নবী সুলাইমান বিয়ে করেন, তিনি তার রাজত্ব এবং বিপুল সম্পদ অধিকার করেননি। শেবা রাজ্যের রাজ দায়িত্ব এবং তার সম্পদের মালিকানা আমৃত্যু বিলকিসেরই ছিল।

তাহলে ইসলাম আর নারীবাদে বিরোধ কোথায় :  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অদিতি সবুর মনে করেন, আদর্শিক জায়গায় বড় ধরণের বিরোধিতা না থাকলেও মূল সমস্যা প্রয়োগে। ইসলাম ধর্মে নারীর সমতা নিয়ে মূল সমস্যা হয় ধর্মের ব্যাখ্যায়। মনে রাখতে হবে, ধর্ম যেখানে ব্যবহার হচ্ছে, যে প্রেক্ষাপটে ব্যবহার হচ্ছে, তার প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে ওই ধর্মের ব্যবহার। অনেক দেশে কুরআনের ব্যাখ্যার অপব্যবহার করে নারীর অধিকার খর্ব করা হয়েছে এমন নজির আছে। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন এভাবে, ‘ধর্ম বিষয়টি তো অনেক বেশি প্রাতিষ্ঠানিক। আর মানুষ তো সাধারণত ধর্মপ্রাণ, ফলে ধর্মের মাধ্যমে একটি ব্যাখ্যা করলে মানুষ সেটা মেনে নেয়, কিন্তু সে কথা হয়ত কুরআনে ওইভাবে বলা হয়নি। ফলে ইসলাম ধর্ম হয়ত নারীকে অধস্তন করছে না, কিন্তু ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে হয়ত নারীবাদকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে।.

বিবিসি বাংলা