| |
               

মূল পাতা আরো পাঠকের কলাম ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও আমাদের অবস্থান


ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও আমাদের অবস্থান


হুযাইফা ইবনে ওমর     26 February, 2022     12:37 PM    


যুদ্ধ মানেই প্রাণহানি, রক্তপাত। এককথায় মানবিক বিপর্যয়। যা কখনোই কাম্য নয়। যুদ্ধ লেগেছে ইউক্রেন-রাশিয়ায়, দুটিই অমুসলিম রাষ্ট্র। তার মানে এই নয় মুসলমানদের ফুর্তি লেগেছে! তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই! বিশ্বায়নের এই যুগে এমনটি ভাবার কেনো সুযোগ নেই। কারণ পৃথিবীর যে প্রান্তেই যুদ্ধ লাগুক না কেন, এর প্রভাব কমবেশি বিশ্বের সব দেশেই পড়বে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রভাবে শুধু বিশ্ব রাজনীতি নয় অস্থিরতা বাড়াবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও। এমনটিই মনে করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকগন। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়বে তেল-গ্যাসের দাম, প্রভাব ফেলবে শেয়ার মার্কেটেও। আর নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, তাৎক্ষণিক ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক এবং কুটনৈতিকভাবে বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলবে এই সংঘাত। অতএব, মুসলমান তো বটেই, যুদ্ধবিগ্রহ এই মুহূর্তে শান্তিপ্রিয় কোনো জনগোষ্ঠীরই কাম্য নয়। তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের নাগরিকদেরও একই অবস্থান হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে দেশের কথিত প্রগতিবাদীরা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন কে বাহ বাহ দিচ্ছে। তারা মুখে সবসময় শান্তির বুলি কপচালেও রাশিয়ার একতরফা আগ্রাসী যুদ্ধকে যেন করতালি দিয়েই উস্কে দিচ্ছে। আবার আমরাও অনেকেই বুঝে না বুঝে তাদের সাথে তাল মেলাচ্ছি।

প্রথমত শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে, দ্বিতীয়ত মুসলমান হিসেবে এবং সেইসাথে বাংলাদেশী হিসেবেও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতকে আমাদের না বলা উচিত। শান্তিপ্রিয় হিসেবে কেন, তা তো পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এবার আসি মুসলমান হিসেবে কেন এই সংঘাত কে না বলতে হবে? খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কালেই রাশিয়া, সাইবেরিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী, সাইপ্রাস এসব অঞ্চল মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সেই সুবাদেই ইউক্রেন ছিল মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। এখানে গড়ে ওঠেছিল অসংখ্য মাসজিদ এবং ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এসব অঞ্চল আবারো মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

অঠারোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তে রুশ আগ্রাসনের ফলে এসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারায় তুর্কি তথা উসমানীয়রা। ফলে ঘোর দুর্দিন নেমে আসে সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের ভাগ্যে। গুড়িয়ে দেয়া হয় এই অঞ্চলের প্রায় হাজারখানেক মসজিদ। গ্রন্থাগারগুলোতে থাকা সকল ইসলামী বই-পুস্তক জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সকল ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়। হজ্জ নিষিদ্ধ করে সেসময়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় মুসলমানদের। ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে বলশেভিক আন্দোলনের মাধ্যমে জার সম্রাটদের উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম নিলে ইউক্রেনের ইসলাম ও মুসলমানদের উপর নেমে আসে আরেক কালো অধ্যায়। মুসলিম কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আলেমগণকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং মাসজিদ, মাদরাসাগুলোকে গুড়িয়ে দেয়া হয়।

তবে ১৯৮৫ তে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ইউক্রেন স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। তখন দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পুনরায় মুসলমানদের নিরাপদ আবাস গড়ে ওঠে। নির্বাসিত মুসলিমরা ক্রিমিয়ায় ফিরে আসে। মুসলমানগণ এখানে আবারো স্বাধীনভাবে বাঁচার সুযোগ লাভ করে। তারা এখানে নিজেদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধারণ করে নিরাপদেই বসবাস করতে থাকে। ইউক্রেনে খ্রিষ্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এখানকার মুসলিম বাসিন্দাদের সাথে তাদের সহাবস্থানে সর্বদাই অটুট ছিল।

কিন্তু এই সুদিনও মুসলমানদের ভাগ্যে বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া অঞ্চলকে রাশিয়া পুনরায় জবর দখল করে নেয়। আবারো ঘোর দুর্দিন নেমে আসে এ অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের জীবনে। ক্রিমিয়া অঞ্চল হাতছাড়া হওয়ার পর সম্প্রতি ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য পদ লাভে তৎপর হয়ে ওঠে। যা রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। যার শেষ দেখে নিতেই রাশিয়ার আজকের এই সামরিক পদক্ষেপ। অপরদিকে পশ্চিমা মিত্র শক্তিগুলো মুখে বড় বড় বুলি ছাড়লেও ন্যাটোভুক্ত করা তো দূরের কথা যুদ্ধ ক্ষেত্রেও কার্যত তারা ইউক্রেনের পাশে নেই। দিনশেষে দুর্দিন সাধারণ মানুষের, আখেরে দূর্গতি মুসলমানদেরই। রাশিয়া কর্তৃক বার বার এই অঞ্চলের মুসলমানদের ভাগ্যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সৃষ্ট ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে ক্রিমিয়ার মুসলিমরা। তাই মুসলমানদের সর্বাত্মকভাবেই এই রুশ আগ্রাসন কে না বলা উচিত।

এবার আসি বাংলাদেশী হিসেবে কেন রুশ আগ্রাসনের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে?

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশীদের একটি নির্মোহ মুক্তি আন্দোলন গড়ে ওঠে। যা প্রথমে ৬ দফার মোড়কে শুরু হলেও পরে মুক্তি আন্দোলনে রূপ নেয়। বাংলাদেশীদের এই নির্মোহ মুক্তি আন্দোলনকে মস্কো ও বেইজিং পন্থী সমাজবাদীরা প্রথমে হাইজাক করে এটাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু পরের গরম করা তাওয়ায় রুটি সেকে কি আর বিপ্লব হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের সস্তা বিপ্লবের সাধ আর মেটেনি। তবে এখানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল স্পিরিট সর্বপ্রথম বাধাগ্রস্ত হয়। কারন তারা বসে থাকেনি। তারা জেদের ভাত কুকুর কে খাওনোর মত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে ভারতের স্বার্থের পালে হাওয়া দিতে থাকে। যা তারা আজও অব্যাহত রেখেছে।

বাংলাদেশী মানুষের নিরেট একটি মুক্তির সংগ্রাম কে মস্কোপন্থীরা কৃত্রিমভাবে জাতিগত সংঘাত হিসেবে দাড় করিয়ে স্বাধীনতার এত বছর পরও জাতির মাঝে বিভক্তি জিইয়ে রেখেছে। যার ফলে স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল আজও ভোগ করতে পারেনি অভাগা বাংলাদেশিরা। তারা সংগ্রাম করেছিল শোষণ থেকে মুক্তির জন্য । কিন্তু তাদের সংগ্রামের ফসল হিসেবে শোষনের হাতবদল হয়েছে মাত্র। শোষণ থেকে মুক্তি অধরাই রয়ে গেছে এ জাতির ভাগ্যে।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের স্পিরিট কে নিজেদের কুক্ষিগত করার চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে শেষে দিল্লির ক্রীড়নক সেজে আজও দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে চলেছে দেশের মস্কোপন্থী সমাজতন্ত্রীরা। যার ফলে মুখে সবসময় শোষনের বিরুদ্ধে তর্জন-গর্জন করলেও ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বরাবরই নিশ্চুপ তারা। একই সূর ধরেছে তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ব্যাপারেও। সুতরাং ইউক্রেনে চলমান রুশ আগ্রাসনের ব্যাপারে দেশের কথিত প্রগতিবাদীদের সাথে সূর মেলানোর আগে প্রথমত একজন মুসলমান, দ্বিতীয়ত একজন স্বাধীন বাংলাদেশী হিসেবে উপরোক্ত ব্যাপারগুলো অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।

লেখক :  সাধারণ সম্পাদক. ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ