| |
               

মূল পাতা সম্পাদকীয় ভাষা আন্দোলনে আলেম সমাজের অবদান


ভাষা আন্দোলনে আলেম সমাজের অবদান


সাদ আবদুল্লাহ মামুন     21 February, 2022     05:22 PM    


ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য তো বটেই, আমাদের এ দেশ ও জাতির জন্য দরকারি উপকারী ছোটবড় সকল অর্জনেই আছে আলেমসমাজের মর্যাদাপূর্ণ অংশগ্রহণ। অবাক হয়েও আখের আমাদের স্বীকার করে নিতে হয়, জাতীয় জীবনের বহু অর্জনে আলেমসমাজের শুধু ভূমিকাই নয়; রয়েছে নেতৃত্বপ্রদানকারী বিস্ময়কর অবদান। এক ভাষা আন্দোলনের কথাই বলা যাক। ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে সমাপ্তির সব পর্বেই রয়েছে ওলামায়ে কেরামের উজ্জ্বল অবদান। এটি কোনো অলীক দাবি নয়; নয় কল্পবিলাস। বরং ইতিহাসই এর জীবন্ত দর্পণ আর জ্বলন্ত সাক্ষী।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে আমাদের অনেক কজন বরেণ্য আলেম অমর হয়ে আছেন। বিশেষভাবে মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ মাওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী রহ. ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের উজ্জ্বল নাম।

ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী বলেন, বাংলা ভাষার পক্ষে সবার আগে কলম ধরেন আমাদের সাহসী সাংবাদিকগণ। এঁদের মধ্যে অগ্রচারণ ছিলেন ‘মোহাম্মদী’, ‘সেবক’ ও আজাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার গুরুত্ব এবং সারবত্তা কতখানি যুক্তিযুক্ত তার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় প্রথম জোরালো বক্তব্য রাখেন এই তেজস্বী সাংবাদিক। (মুকুল চৌধুরী সম্পাদিত, অগ্রপথিক সংকলন ভাষা আন্দোলন : পৃ. ২৯২, প্রকাশকাল : ১৯৯৩ ঈ.)

ড. এএসএম আজিজুল্লাহ বলেন, যে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারছি; সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ হলেন মাওলানা আকরম খাঁ। (দৈনিক ইনকিলাব : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও ভাষা আন্দোলনে মাওলানা আকরম খাঁ-সহ প্রমুখ যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা অতিশয় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। (মুহাম্মদ মতিউর রহমান, বাংলা ভাষা ও ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন : পৃ. ৩৫)

সমাজ-সংস্কারক ও দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী আলেম মাওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী রহ.। ইসলাম, দেশ ও মানুষের কল্যাণে জীবনবিলানো একটি নাম। গবেষক-লেখক শামসুজ্জামান খান মহান এই কর্মবীর আলেম সম্পর্কে লিখেছেন : মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর চিন্তার অগ্রগামিতার পরিচয় পাই বশিরহাট সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে : ...বাঙালি মোছলমান যে আজ পদে পদে লাঞ্ছিত ও সকল প্রকার অধিকার হইতে বঞ্চিত তাহার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করিতে গেলে জানিতে পারা যাইবে মাতৃভাষার সেবায় অভাবই আমাদের জাতীয় জীবনের দুর্দশার প্রধান কারণ। (শামসুজ্জামান খান, মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী : ৩৯)

প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম বলেন, স্বজাতির কল্যাণ কামনার চেতনা ও স্বজাত্য বোধের বিষয়ে তিনি মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। এই অনুপ্রেরণাই তাকে ভাষা আন্দোলন ও বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছে। (ভাষা আন্দোলন, অগ্রপথিক সংকলন : পৃ. ৮০৫)

সাংবাদিক মাওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী রহ. লিখেছেন : মাওলানা আতহার আলী রহ. বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। তাঁর জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (নেজামে ইসলাম পার্টি) বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। (বাংলাদেশের সংগ্রামী ওলামা পীর-মাশায়েখ : ১০১)

মরহুম শেরে বাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, মাওলানা আতহার আলী রহ.-সহ প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে। নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটি ঘোষণা, সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। মাওলানা আতহার আলী ও ভাসানী ছিলেন যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা। বাংলাদেশের এসব জাতীয় অর্জনে তাঁদের রয়েছে গৌরবময় অবদান ও প্রচেষ্টা। (মুফতি আবদুস সাত্তার কিশোরগঞ্জী, ইসলাম ও মাতৃভাষা : ১৫৬)

হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.। বাংলা সাহিত্য-সাংবাদিকতার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পাকিস্তান সরকার যখন এ দেশের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তাচ্ছিল্য মনোভাব প্রকাশ করে তখন মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. সাহসী কণ্ঠে প্রতিবাদ করে বলেন : পাকিস্তানের এক ডানাকে দুর্বল করে ধ্বংস ডেকে আনা হবে আত্মহত্যার শামিল। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দান আমাদের ন্যায্য অধিকার। -(মাওলানা লিয়াকত আলী সম্পাদিত, হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. স্মারকগ্রন্থ : ১০৮)

খতিবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমাদ রহ. মুসলিম যুবসমাজকে বাংলা ভাষার প্রতি উৎসাহিত করতেন। পাকিস্তান সরকার যখন বাংলা ভাষাকে মিটানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন তিনি বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে, সভা-সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সোচ্চার দাবি জানাতে থাকেন।

জনাব সিরাজুল ইসলাম বলেন, মাওলানা আতহার আলি, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, মাওলানা সাখাওয়াতুল আমবিয়া, মৌলভি ফরীদ আহমাদ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম পার্টি ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করে। -(ভাষা আন্দোলন, অগ্রপথিক সংকলন : ১৩৩)

যুলুমবাজ ও নিপীড়ক জমিদারি-প্রথা বিরোধী আন্দোলনের নেতা, তেজস্বী রাজনীতিবিদ মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী রহ.। ১৯৫২ সালে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বহু ইশতেহার প্রকাশ করেন। ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, বৃটিশ ও জমিদারি-প্রথা বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাওলানা পাঁচবাগী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। (বৃহত্তর মোমেনশাহি উলামা ও আকাবির : ১১৮)

আলেমসমাজের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান বাংলা ভাষার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। তখন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বলেন, পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হবে উর্দু; অন্য কোনো ভাষা নয়। জিন্নাহর এ ঘোষণায় পূর্ব বাংলায় দারুণ ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। শুরু হয় বাংলা ভাষার স্বপক্ষে মরণপণ সংগ্রাম।

১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার জেলা বার লাইব্রেরি হলে সর্বজনাব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সদস্য তালিকার প্রথম নামটিই হলো, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। (মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, বাংলার সংগ্রামের ইতিহাস ১৭৫৭-১৯৯০ : পৃ. ১১৪)

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ রহ. ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা পরবর্তী টানা দশ বছরের সভাপতি। অন্যতম যোগ্য, উচ্চশিক্ষিত ও প্রকৃত সংস্কৃতিবান ব্যক্তি। সৎ নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ। ১৯৫২ সালে তিনি সরকার দলীয় এমপি। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন সংসদ অধিবেশন চলছিল। ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে কঠিন প্রতিবাদ জানান। স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বজ্রকণ্ঠে বলেন : এ মুহূর্তে রাজপথে গোলাগুলি চলছে। এমন পরিস্থিতিতে অধিবেশন বসতে পারে না। যখন গুলিতে ছাত্রদের লাশ পড়ে আছে তখন জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের এই পরিষদে বসে থাকার কোনো অধিকার নেই- এই বলে তিনি ওয়াকআউট করেন। তিনি কেবল পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেই ক্ষান্ত হন নি, বরং পার্টির সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেন। (মুফতি আবদুস সাত্তার কিশোরগঞ্জী, ইসলাম ও মাতৃভাষা : ১৬২)

বলতে গৌরব লাগছে, ভাষা আন্দোলনে অগ্রে ও নেতৃত্বে থাকার ইতিহাস যেমন আলেমসমাজের; তেমনি মাতৃভাষা বাংলার জন্য বুকের তাজা খুন দেওয়ার কৃতিত্বও মুসলিম যুবকদের। ভাষার জন্য শহিদ হয়েছেন : আবুল বরকত, রফিক, আবদুস সালাম, আবদুল জাব্বার, শফিউর রহমান, আবদুল আউয়াল, অহিউল্লাহ প্রমুখ। আর আহত হয়েছেন : সিরাজ উদ্দিন খান, আনোয়ারুল ইসলাম, এম এ মোতালেব, এলাহি বকশ, মনসুর আলী, বছির উদ্দীন আহমদ, তাজুল ইসলাম, মাসউদুর রহমান, আখতারুজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক, মোজাম্মেল হক, সুলতান আহমদ প্রমুখ। -(ইসলাম ও মাতৃভাষা : ১৪১)

বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটি ঘোষণা, মাতৃভাষার মাধ্যমে পাঠদান আইন এবং বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামের অবদান অনস্বীকার্য। যেভাবে আলেমসমাজের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন সূচিত হয়েছে তেমনি সাফল্যও অর্জিত হয়েছে ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে। বলতে আমোদ লাগছে, বাংলা ভাষা পবিত্রতার আবহে গতিশীলভাবে লালিত ও বিকশিত হয়ে চলছে আলেমসমাজের হাত ধরে।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ বলেন : মুসলিম বাংলার সৌভাগ্য, উর্দু প্রীতি যাদের বেশি থাকার কথা, সেই আলেমসমাজই পাকিস্তানিদের ভাষাবিষয়ক অপচেষ্টায় বাধা দিয়েছিলেন। বাংলার আলেম সমাজের মাথার মণি মাওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফি উর্দুবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। (ড. এএসএম আজিজুল্লাহ, দৈনিক ইনকিলাব : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০)

বিশ্ব ইতিহাস কলঙ্কিত একটা অধ্যায় বয়ে বেড়াচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে চলছে ইসলাম ও ওলামায়ে কেরামের অবদান বিষয়ে বিদ্বেষ ও কলুষ-নীতি। বাংলাদেশেও বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও অবদান বিষয়ে বহু কাল থেকে হয়েছে অনেক অপরাজনীতি। কিন্তু এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, মাতৃভাষা বাংলার অস্তিত্ব রক্ষায় যেমন আলেমসমাজ আন্দোলন করেছেন; তেমনি তাদের উত্তরসূরীরা সংগ্রাম করে চলেছেন, ভাষাকে কদর্য ও অশ্লীলতার নাপাকি থেকে উদ্ধার করতে! অবিশ্বাস ও অপবিশ্বাসের কদাচার থেকে পবিত্র রাখতে!

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক