রহমত ডেস্ক 01 January, 2022 02:51 PM
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, সরকারের চেয়ে রাষ্ট্র অনেক বড় ধারণা। সরকার দলের হয় আর রাষ্ট্র হয় সবার। সেই রাষ্ট্রের প্রধান যখন কোন সংলাপের আমন্ত্রণ জানান, তখন তাতে সাড়া দেওয়া নাগরিক দায়িত্ববোধের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই বোধ থেকেই আমরা ২০১২ ও ২০১৭ সালের সংলাপে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু তিক্ত সত্য হলো, আমরা চরমভাবে হতাশ হয়েছি। ২০১২ এর সংলাপে গঠিত নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে একতরফা নির্বাচন এর আয়োজন করেছে; যেখানে ১৫৩ জন এমপিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী দেখানো হয়েছে। আর ২০১৭ এর সংলাপের পর গঠিত কমিশন ১০১৮ সালে একটি চরম বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছে। যাকে অনেকেই মধ্যরাতের নির্বাচন বলে আক্ষায়িত করে থাকে। এই দুই জাতীয় নির্বাচন এতটাই বিতর্কিত ও জালিয়াতিতে পূর্ণ যে, তা জাতি হিসেবে আমাদেরকে চরম হতাশ, বিব্রত ও লজ্জিত করেছে। আরও হতাশাজনক ব্যাপার হলো, এই ইসির নিয়োগকর্তা মহামান্য রাষ্ট্রপতি এসব কলঙ্কময় নির্বাচনের দায়ে তারই গঠিত কমিশনকে কোনরকম জবাবদিহিতার আওতায় আনেননি; কোন রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ফলে রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপকে আমাদের কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়। তাছাড়া অতীতের দুটি সংলাপে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে রাষ্ট্রপতির কাছে আমাদের গঠনমূলক প্রস্তাবগুলোর কোনটাই মূল্যায়ন করা হয়নি। যে দল তাঁকে রাষ্টপতি হিসাবে নির্বাচিত করেছে, তিনি সেই দলীয় স্বার্থের বাইরে যেতে পারেননি।
আজ (১ জানুয়ারি) শনিবার রাজধানীর পল্টনস্থ নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী, খন্দকার গোলাম মাওলা, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সহকারি মহাসচিব হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, মাওলানা ইমতিয়াজ আলম, কেএ আতিকুর রহমান, মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম, মাওলানা খলিলুর রহমান, জিএম রুহুল আমিন, মাওলানা লোকমান হোসাইন জাফরী, এডভোকেট লুৎফুর রহমান শেখ, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, আলহাজ্ব আব্দুর রহমান, মাওলানা নেছার উদ্দিন, এডভোকেট শওকত আলী হাওলাদার, মাওলানা মকবুল হোসাইন প্রমুখ।
চরমোনাই পীর বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংলাপ বর্জন করার সাথে সাথে জনগনের ভোটের অধিকার প্রাপ্তির জন্য একগুচ্ছ প্রস্তাবনা পেশ করছে; এখানে প্রসঙ্গত, অনেকেই ইসি গঠন নিয়ে আইন প্রণয়নের কথা বলছেন। আইন প্রণয়নের প্রস্তাব যৌক্তিক এবং এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইন প্রণয়ন করবে কে? একটি বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করা সাংসদবৃন্দ? যাদের নিজেদেরই নৈতিক ভিত্তি নাই। একটি দলান্ধ ও মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের সুবিধাভোগী সাংসদবৃন্দ কোন স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আত্মমর্যাদাশীল ইসি গঠনে কার্যকর আইন প্রণয়ন করবে, এমন আশা করা বাহুল্য। সেজন্য আমরা বলব-
দাবি:-১. নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আইন অবশ্যই করতে হবে। তবে জনগণ বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া এই সংসদের উপরে ইসির মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের আইন তৈরির দায়িত্ব দিতে চায় না। বরং আমরা বলব, সকল রাজনৈতিক সংগঠন ও সমাজের স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল গঠন করুন। সেই কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল ইসি গঠন সংক্রান্ত আইন প্রস্তুত করে চলতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল গঠিত নতুন ইসির মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করে নতুন গ্রহণযোগ্য সংসদে ইসি আইন চূড়ান্ত করতে হবে।
দাবি:-২. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পর সম্পর্কিত। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আলোচনা করা প্রকারান্তরে মূল ইস্যুকে আড়াল করার নামান্তর। সেজন্য নির্বাচন কমিশন গঠনের সাথে সাথে নির্বাচন কালীন সরকার ইস্যুও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটা প্রমাণিত বাস্তবতা। তাই নির্বাচনের সময় অবশ্যই অন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে।
দাবি:-৩. আমাদের সংবিধানের ১১৮ এর ৫ উপধারায় নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের অপসারণ পদ্ধতিকে বিচারপতিদের অপসারণ অনুরূপ করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন উভয়টাই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও ইসির কোন ভুল, অন্যায় ও অনিয়মের প্রভাব অনেক বেশি ও বিস্তৃত। সেজন্য ইসলামী আন্দোলন প্রস্তাব করছে যে, ইসি আয়োজিত প্রতিটি নির্বাচনের পরে কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচন ও ইসির মূল্যায়ন করতে হবে। নির্বাচনে কোন ধরনের অসততা, অদক্ষতা ও পক্ষপাত পাওয়া গেলে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের অপসারণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
দাবি:-৪. জনপ্রশাসন, আইন, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
দাবি:-৫. নির্বাচন কমিশনের বাজেট, সচিবালয় ও পরিচালনা নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিতে হবে।
দাবি:-৬. নির্বাচন কালীন সহিংসতার প্রতিটি অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইসিকেই নিতে হবে।
দাবি:-৭. সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাউকে কাউকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি করতে দেখা গেছে। যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে তাদেরকে চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ উপায় নির্ধারণে এই ব্যর্থতা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। স্বাধীনতার বিগত ৫০ বছরে কেন একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের রূপরেখা হলো না। এখনো কেন্ জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে হয়। এর জবাব স্বাধীনতা পরবর্তী যে ৩টি দল রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে তাদেরকেই দিতে হবে। ৩টি দলই সংবিধানকে অবজ্ঞা করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যারা বিগত দিনে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে জনগণের অধিকারকে কুক্ষিগত করেছে, তাদেরকে অবশ্যই জনগণের কাঠগড়ায় দাড় হতে হবে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে, রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের জন্যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।