এম. এ. ইউসুফ আলী 31 December, 2021 03:43 PM
খ্রিষ্টবর্ষের ৩১ শে ডিসেম্বর রাত ১২ টা ১ মিনিটকে থার্টিফার্স্ট নাইট হিসাবে উদযাপন করা হয়। পুরনো বছরকে বিদায় জানানো ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উপলক্ষে নেশা ও অবৈধ যৌনতার উন্মাদনায় মেতে উঠে মানবসন্তানেরা। অপচয় ও অপব্যয়ের প্লাবনে ভাসে একেকটি আয়োজন। ইসলামি জীবন বিধান অনুযায়ী একাজগুলো মারাত্মক অপরাধ। সারাবিশ্বের মুসলিম মনীষীগণ এ দিবস পালনের অপসংস্কৃতিকে হারাম বলে অভিহিত করেছেন।
উৎপত্তি:
ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হয় ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে। এই ক্যালেন্ডার চালু করেন খ্রিষ্ট ধর্মের যাজক পোপ গ্রেগরি। ইতিপূর্বে নববর্ষ পালনের রীতি বিভিন্ন সভ্যতায় থাকলেও পাকাপোক্তভাবে ১লা জানুয়ারি নববর্ষ পালনের রেওয়াজ শুরু হয় এ সময় থেকে।
বাংলাদেশে প্রসার:
বাংলাদেশে ২০০০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর মধ্যরাতের মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দ পালনের মধ্য দিয়ে। এরপর এ অপসংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিত্তশালী ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক-যুবতীদের মধ্যে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এ রাত্রিতে নতুন বর্ষে পদার্পন উপলক্ষ্যে বেহায়া-বেলেল্লাপনার সাগরে হারিয়ে যায় যুবক যুবতিরা। হেন কোনো অপরাধ নেই যা আমাদের সমাজে সংঘটিত হয় না। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়।
এ দিবস পালনের ক্ষেত্রে যা যা ঘটে;
০১. বিধর্মীদের সাদৃশ্য:
থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের রীতি চালু হয়েছে খ্রিষ্ট জগতে। সুতরাং এ দিবস পালনের মাধ্যমে বিধর্মীদের সাদৃশ্য অর্জন করা হয়। ইসলামবিজাতীয় সংস্কৃতি পালন করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত দীন। (সুরা আল ইমরান : আয়াত ১৯)
তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের অনুসরণ করবে কখনো তার সেই আমল গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সুরা আল ইমরান : আয়াত ৮৫)
আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করলো; সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’
০১. আঁটসাঁট পোশাক পরা:
তরুণ-তরুণীরা নগ্নপ্রায় পোশাক পরে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেন, যে নারীরা পোশাক পরা সত্ত্বেও উলঙ্গ, পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে, নিজেরাও আকৃষ্ট হয়, যাদের মাথা বাকা উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের মতো; তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২১২৮)
০৩. ট্যাটু আঁকা:
ট্যাটু বা উল্কি অঙ্কন বলতে বুঝায়, শরীরের চামড়ায় সুঁই বা এ জাতীয় কোনো কিছু দিয়ে ক্ষত করে তাতে বাহারি রং দিয়ে নকশা করা। ইসলামের দৃষ্টিতে ট্যাটু আঁকা হারাম।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যে মহিলারা নকল চুল ব্যবহার করে, অন্য মহিলাকে নকল চুল এনে দেয়, নিজ শরীরে উল্কি অঙ্কন করে নেয় কিংবা অন্যের শরীরে উল্কি অঙ্কন করে দেয়, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের অভিশাপ দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস: ৫৫৯৮, মুসলিম, হাদিস : ৫৬৯৩)
০৪. আতশবাজি, পটকাবাজি:
আনন্দের আতিশয্যে মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আতশবাজি ও পটকাবাজির মহড়া। বিভিন্ন সড়কে, ভবনের ছাদে, প্রকাশ্যে স্থানে উঁচু আওয়াজের পটকা ফুটানো হয়, এ ধরনের অসুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি হয়। সাধারণ জনগণ বিরক্ত হোন এবং হৃদরোগীরা ভীষণ কষ্ট পান। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে বলেন, যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়; তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। (সুরা আল আহযাব, আয়াত: ৫৮)
০৫. গান-বাজনা:
ডিজে পার্টি, ফ্যাশন শো, ফায়ার প্লে, কনসার্ট, অশ্লীল নৃত্য, ফানুস উড়ানো ইত্যকার কাজগুলো ছাড়া কোনো বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয় না। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। এদের জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি’। (সুরা লুকমান আয়াত: ৬ আয়াত)।
আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পৃথিবীতে ধ্বসিয়ে দিবেন।– ( ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০২০, সহিহ ইবনু হিব্বান হাদিস : ৬৭৫৮)
০৬. মাদক সেবন:
এ রাতে তরুণ-তরুণীরা মাদক রাজ্যে অবগাহন করে। মাতাল হয়ে ঘটায় নানা অপকর্ম।
আল্লাহ তাআলা মাদক থেকে নিষেধ করে বলেন, ‘মুমিনগণ, মদ-জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি, ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। মদ ও জুয়ার মাধ্যমে শয়তান তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায়, চায় আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদেরকে বাধা দিতে। কাজেই তোমরা কি এসব থেকে বিরত হবে না? (সুরা মায়েদা আয়াত: ৯০-৯১)।
০৭. জেনা ব্যভিচার:
এ রাত্রিতে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেশা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। আবাসিক হোটেল, কমিউনিট সেন্টার, পানশালা, নাচঘর, সমুদ্র সৈকত, নাইট ক্লাবগুলো পরিণত হয় একেকটি অঘোষিত পতিতালয়ে। সতীত্ব হারায় আমাদের উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা। আল্লাহ তাআলা জেনা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হতেও বারণ করেছেন, তিনি বলেন,
তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ। (সুরা বানি ইসরাইল, আয়াত ২২)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অবশ্যই কোন পুরুষ কোন নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হলে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।
০৮. অর্থ অপচয়:
এ রাত উপলক্ষ্যে যে সকল আয়োজন করা হয় সর্বক্ষেত্রেই থাকে অর্থ-অপচয়ের প্লাবন। অথচ ইসলাম যাবতীয় অর্থ অপচয় থেকে বারণ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ২৬-২৭)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘আদম সন্তান, তোমরা প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পোশাক পরো। খাও, পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’ ( সুরা আল আরাফ, আয়াত: ৩১)।
০৯. সময়ের অপচয়:
ইসলাম ধর্মানুযায়ী মানুষের প্রতিটি মুহূর্তই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপন করে যে সময়গুলো নষ্ট করছি সেগুলো কি কখনও ফিরে আসবে? এ সময়টিতে আত্মপর্যালোচনা করার প্রয়োজন ছিল, বিগত বছরটা কতটুকু উৎপাদশীল ও কল্যাণকর কাজে ব্যয় করতে পেরেছি? আমি তো দিনদিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্চি। সুতরাং আগামীর দিনগুলো যেন এরচেয়েও বেশি ফলপ্রসূ হয়।
১০. শিরকযুক্ত স্লোগান:
এ রাতে বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে শিরকযুক্ত স্লোগান দেওয়া হয়। লোকজন বলে,
“মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা
অগ্নি স্নানে সূচি হোক ধরা।”
এ স্লোগানে অগ্নিপূজকদের আগুন দ্বারা পবিত্র হওয়ার ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিত হয়। যা শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর সঙ্গে অংশীস্থাপনকারীকে ক্ষমা করবেন না।’ (সুরা আন নিসা: আয়াত ১১৬)
কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে ধ্বংস করতে হয় তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি ঐতিহ্য; তাহলে ধ্বংসযজ্ঞের বাকি কাজ এমনিতেই সমাধা হয়ে যায়। বদলে যায় ইতিহাসের গতিপথ। উইলিয়াম হ্যান্টিংটন ক্লাস অব সিভিলাইজেশন বইয়ে লিখেন, ইসলামি সভ্যতাই পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান সমস্যা। তাই তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে আমাদেরকে কাবু করতে চায়।
অতচ বাস্তবতার নিরিখে যাচাই করলে দেখা যায় এ দিবস শুধু বাংলাদেশের রাষ্টধর্ম ইসলামের মানদণ্ডেই অবৈধ তা নয় বরং বাঙালি সংস্কৃতিতেও এর কোনো বৈধতা নেই। আজ বাংলাদেশে ধর্মীয় মূল্যবোধ নষ্ট হওয়া ও পারিবারিক বন্ধন টুটে যাওয়ার বড় অনুঘটক হিসেবে এ ধরনের দিবস পালনের দায় এড়ানো যাবে না। সুতরাং থার্টি ফার্স্ট নাইটের মতো অসাংবিধানিক সাস্কৃতিক আগ্রাসন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
আসুন, আমরা অনতিবিলম্বে ঈমান ও সমাজবিধ্বংসী অপসংস্কৃতি পরিত্যাগ করে আচার-আচরণে, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: মাস্টার্স (অধ্যয়নরত), আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।