রহমত নিউজ 17 January, 2025 11:20 AM
মানুষ কত আদর আর যত্ন দিয়ে বিড়াল পোষে অথবা একটা বিদেশি কুকুর। দু'দিন আগে ফেসবুকে দেখলাম এক মেয়ে শ্বশুরের উপর ভীষণ রাগ করে পোস্ট দিয়েছে। অভিযোগ হলো, শ্বশুর তার আদুরে বিড়ালকে (লিও) নিজের ভাগ থেকে মাছ-মাংস খেতে দেয়। এই নিয়ে পুত্রবধূ আর শ্বশুরের মধ্যে বহুবার ঝগড়াও হয়েছে, লেকিন কোন কাজ হয়নি।
বলে রাখা ভালো, বিড়ালটাকে সে প্রত্যহ শুধু পানি দিয়ে মাছ-মাংস সেদ্ধ করে খাওয়াতো। সেই বিড়াল শ্বশুরের দেওয়া মাছ-মাংস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জিহ্বা দিয়ে লালা ঝরছে। ভেটের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, অতিরিক্ত ঝাল খেয়ে বিড়ালের (লিও) আলসার হয়ে গেছে। ঘটনা এতটুকুই। তবে এই ঘটনায় মেয়েটা যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছে, তা হয়তো বর্ণমালায় বর্ণনা করা আমার জন্য ঈষৎ অসম্ভব।
বিড়াল কিংবা কোন প্রাণীর উপর বিদ্বেষ আমার নেই। কিন্তু একটা তুলনা মনের মধ্যে হামেশাই ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষের থেকেও কি একটা বিড়ালের মান-মর্যাদা অথবা গুরুত্ব বেশি হওয়া উচিত? কক্ষনো না! মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু এই ঘটনার দিকে খেয়াল করলে দেখবেন, তিনি আশেপাশের মানুষদের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসে তার বিড়াল লিওকে।
বহুবার হয়তো এমন হয়েছে, একজন অসহায় ভিক্ষুক তার দিকে প্রবল আকাঙ্খা নিয়ে এগিয়ে এসেছে আর তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিংবা সামান্য ক'টা টাকার জন্য একজনের চিকিৎসা হচ্ছে না, বিষয়টা তিনি উপেক্ষা করেছেন। তার বাড়ির দারোয়ানের স্ত্রী কিংবা সন্তান খুবই অসুস্থ, জানার পরেও বেতনের বেশি এক টাকাও তিনি দেননি। ড্রাইভার একদিনের জন্য ছুটি চেয়েছিল অসুস্থ মা’কে দেখতে যাবে বলে, সেটাও হয়তো তিনি দেননি।
করোনাকালের কথা! সমগ্র দেশ তখন লকডাউন। টিকাটুলিতে মধ্যবয়সী এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। বিকেলে তার ছেলে আমাদের ফোন করে বললেন, আপনারা আমার বাবাকে দাফন করে দেন। আপনাদের যথেষ্ট পরিমাণে টাকা দেওয়া হবে। আমাদের টিমের প্রধান তখন বললেন, আমরা টাকার জন্য কাজ করি না। তাছাড়া আমরা কোন সংগঠনের আওতাভুক্ত না। সওয়াবের নিয়তেই মূলত এমন দূর্যোদের মূহুর্তে ছোট্ট একটা দল গঠন করে কাফন-দাফনের কাজ করে যাচ্ছি। বাড়তি কোন টাকা আমাদেরকে দিতে হবে না, শুধু খরচ বহন করলেই হবে।
আমরা সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম মরহুম ব্যবসায়ীর বাড়িতে। বিশাল বড় বাড়ি। আর সেই বাড়ির মালিকের নিথর দেহটা পড়ে আছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। হাসপাতাল থেকে লাশটা যেভাবে রেখে গেছে, সেভাবেই আছে। আশেপাশে কেউ নেই। অনেক্ষণ পর দেখলাম দূরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলে। ওখানে আরও কেউ ছিল কিনা জানি না। তবে সেই ব্যবসায়ীর খুব আদুরে নাতি-নাতনিদেরকে কাছে আসতে দেওয়া হয়নি। মৃত দাদা বা নানার মুখটা পর্যন্ত তারা দেখতে পারেনি।
এইতো ক’দিন আগের নিউজ। সম্পত্তি বণ্টনের জের ধরে গর্ভধারিনী মা এবং ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ছোট ভাই। যেই সম্পত্তিকে ভালেবেসে আপনজনদের তিনি খুন করলেন, তিনি সেই সম্পদের মালিক হবেন নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য। তারপর সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু এই অমানবিকতা... সারাটাজীবন কি তাকে শান্তি দেবে?
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজ্জায় এখন পর্যন্ত ৪৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরাইল। ইহুদিরাও তো রক্তে মাংসের মানুষ, তবুও তারা দখলদারিত্ব চালায় এবং মানুষ হত্যা করে। ভারতে গরু জবেহ করা ভীষণ অপরাধ। কিন্তু সুযোগ পেলেই মুসলমানদের গরদান নেয় হিন্দুত্ববাদীরা। অর্থাৎ পশুপ্রাণীর উপর যেই মায়া আর ভালোবাসা তারা প্রদর্শন করে, সেটিও মিথ্যে হয়ে যায় মাানুষের বেলায়। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা না থাকলে যা হয় আরকি।
মনে রাখতে হবে, মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত। অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব। দুনিয়ার সকল প্রাণীর থেকে তাই মানুষের প্রতি ভালোবাসাটা হাজার-লক্ষ গুণে বেশি হওয়া উচিত। আদম সন্তানের ব্যাপারে অনেক কথা! কিন্তু মানুষের থেকে উত্তম আর কে আছে বলুন? কোন সৃষ্টি কি মানুষের থেকে মহৎ হতে পারে? অসম্ভব! মানুষের থেকে উত্তম এবং মহৎ হতে পারে শুধুই মানুষ।
অতএব, আশেপাশের মানুষের দিকে আমাদের অন্তর নিঙড়ানো ভালোবাসাটুকু বিলিয়ে দিতে হবে। প্রাণীর সাথে আপনার প্রেম থাকতে পারে, তবে মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকবে আরও লক্ষ-কোটি গুণ বেশি। তবেই সুন্দর হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। পূর্ণতা পাবে মানব সভ্যতা।
লেখক : সাংবাদিক